দার্জিলিং জমজমাট : সত্যজিৎ রায় (ফেলুদা #১৫) Darjeeling jomjomat

“নয় অপেক্ষা নয় রে আর, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি জমবে এবার”

২৭ বছরের টকবকে তরুণ। যার উচ্চতা ৬.২”। প্রগাঢ় জ্ঞানের পরিধি সম্পন্ন সজ্জন ব্যক্তি। রহস্য যার নেশা সেই তো ফেলুদা, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ১৯৬৫ সালে বাঙালী পাঠক গোষ্ঠীর সাথে যার পরিচয় ঘটান উপমহাদেশের অস্কারজয়ী নির্মাতা, লেখক, চিত্রশিল্পী, একাধারে অনুবাদক সত্যজিৎ রায়। বাঙালী শখের ডিটেকটিভ হিসেবে ফেলুদার যাত্রা শুরু হলেও, তিনি তাকে দেখিয়েছেন একজন ভ্রমণবিলাসী হিসেবেও। তিনি নিজে একজন ভ্রমণ পাগল লোক ছিলেন বলেই হয়তো ফেলুদার মাধ্যমে তিনি এটি খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কোনো রকম খসড়া ছাড়াই একটা চরিত্রকে সৃষ্টি করেন সত্যজিৎ রায়৷ এ প্রসঙ্গে তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় বলেন, “এক নতুন চরিত্র জন্মের আগে, একজন লেখক সাধারণত যেসব প্রাথমিক খসড়া করে থাকেন, উনি তা কিছুই করেননি।

  • বইয়ের নাম : দার্জিলিং জমজমাট
  • লেখকের নাম : সত্যজিৎ রায়
  • প্রকাশন : আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
  • প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৮
  • প্রচ্ছদ শিল্পী : সত্যজিৎ রায়
  • মুদ্রিত মূল্য : ২২৫৳
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৬

গত চার বছরে লেখা অন্যান্য গল্পের মতো সরাসরি আরম্ভ করে দিয়েছেন।”ফেলুদার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, নয় বছর বয়সে তার বাবা মা মারা যায়। এরপরে বাবার ছোটোভাইয়ের কাছেই ফেলুদা বড়ো হয়ে ওঠে। ফেলুদার জীবনাচরণে জানা যায় ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। ফেলুদার ইতিহাস এবং ভূগোলের দখলও ছিল অনেক। তার গল্পের বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানের ব্যাখ্যা বেশ সুনিপুণ ভাবে সত্যজিৎ দিয়েছে যাতে বোঝা যায় ফেলুদার ভূগোলের দখল কতটুকু। এছাড়াও ফেলুদার চারমিনার সিগারেট খাওয়ার জন্যে কত কিশোর যে সিগারেট ধরেছিল তা বলাই বাহুল্য।অনেকে মনে করেন যে শার্লক হোমস থেকে প্রভাবিত হয়ে সত্যজিৎ ফেলুদাকে সৃষ্টি করেছেন। শার্লকের যেমন একজন সহকারী রয়েছে এবং তার মাধ্যমে রহস্যের বর্ণনা বর্ণিত হয় ঠিক তেমন ফেলুদারও সহকারী তোপসের মাধ্যমে গল্প বা উপন্যাস বর্ণিত হতে দেখে অনেকে ফেলুদাকে বাঙালি শার্লক বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন।

গোয়েন্দা কাহিনিতে সহকারী ক্যারেক্টার থাকা বাঞ্চনীয়। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল থেকে শুরু করে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ অব্দি একজন সহকারী রয়েছে বলেই দেখা যায়। অর্থাৎ যে হত্যাকাণ্ড বা মূল চরিত্রের পদক্ষেপগুলো রচনা করবে। সত্যজিৎ রায় তপেশকে দিয়ে ঠিক এই কাজটাই করিয়েছিলেন। অর্থাৎ ফেলুদার সব ডিটেইলস তপেশ লিখতো। যার মাধ্যমেই ফেলুদার সকল কিছু জানতে পারতো পাঠক। আর তার সঙ্গে যোগ হয় রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু। সোনার কেল্লা উপন্যাসে ফেলুদার সাথে প্রথম পরিচয়। খুব রসিক মানুষ এই জটায়ু।

ফেলুদা পাঠকদের কাছে জটায়ু আরেক ভালোবাসার নাম। লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গেলে দেখা যায় মাঝ বয়সী একটা লোক, মাথায় টাক রয়েছে, নাকের নিচে রয়েছে গোঁফ, পরনে সবসময় ধুতি পাঞ্জাবি, রসিকতা করতে পছন্দ করেন, সিগারেট ছাড়েন আবার ধরেন, চপ্পল পরিধান করেন এবং এ নিয়ে সবাইকে উপদেশ দিতে ভোলেন না। তার গল্পের মেইন ক্যারেক্টারের এত এত গুণ তিনি দিয়েছিলেন যে সেই গুণের কারণে ফেলুদাকেও বেশ উপহাস করতে দেখা গেছে। এছাড়াও তার উপন্যাসে হাস্যরসের উপস্থিতি দেখে প্রায়ই ফেলুদা খোঁচা মারতো। তার ওপর বিভিন্ন ধরনের ভুল ধরিয়ে দিতেও দ্বিধা করতো না।

এই তিন জনকে বলা হতো ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। যাকে বলা যায় হরিহর আত্মা। এদের তিন জনকে নিয়ে এগিয়ে চলে সত্যজিৎ রায়ের বহুল জনপ্রিয় ‘ফেলুদা সিরিজ’। তারই ধারাবাহিকতায় এবার তাদের মিশন দার্জিলিং। তাও আবার সম্ভব হলো জটায়ুর জন্য। দার্জিলিং বরাবরই ফেলুদার অসম্ভব প্রিয় জায়গা। কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য়ে সবসময়ই মুগ্ধ তিনি। লালমোহন বাবুর গল্প দিয়ে ছবি বানাচ্ছেন বোম্বের হিট ডিরেক্টর পুলক ঘোষাল।

তারই আমন্ত্রণে এবার ওদের এই তিন জনের যাওয়া। স্যুটিং হবে রিটায়ার্ড ব্যাংক অফিসার বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে। একা মানুষ এই মি. মজুমদার। সুটিং চলাকালীন সময়ে হঠাৎই নিজ ঘরে খুন হন বিরূপাক্ষ বাবু। ফেলুদা ফেরেন তার নিজ রূপে। অবশ্য মি. মজুমদার আগেই ফেলুদাকে এরকম কিছুরই একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। খুনের সাথে সাথে গায়েব হয়ে যায় মি. মজুমদারের অনেকদিনের পুরোনো আর বিশ্বস্ত ভৃত্য লোকনাথ বেয়ারা। আর তার সাথে অষ্টধাতু মহামূল্যবান সেই মূর্তিটি। লেগে পড়েন এই খুনের রহস্য উন্মোচনে। হত্যাপুরী, টিনটোরেটর যীশু, যত কান্ড কাঠমুন্ডুর পর ফেলুদার হাতে এবারও এ খুনের রহস্যের সমাধান মিলবে কি?

প্রথমে ১৯৮৬ সালে শারী দুর্গাপূজা উপলক্ষে ‘দেশ পত্রিকা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে পুস্তক আকারে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। লেখক তাঁর সকল বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ তিনি নিজেই করতেন। এ বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়।দার্জিলিং আর কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুই দেখা হয়নি আমার। তবে “দার্জিলিং জমজমাট”-এর মধ্যে দিয়ে লেখক লেখনীর মাধ্যমে দেখেছি কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার সৌন্দর্য। সাথে ফেলুদার নিজস্ব ভঙ্গিতে রহস্য সমাধান তো ছিলোই। সবমিলিয়ে বাজিমাত দার্জিলিং জমজমাট।

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *