কদিন আগেই পড়ে শেষ করলাম বাংলার রহস্য ও তন্ত্রভিত্তিক সাহিত্যে নতুন সংযোজন – নীরেন ভাদুড়ি সমগ্র (প্রথম খন্ড)। রিভিউ একটু দীর্ঘ বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
নিকষছায়া উপন্যাসটি বইয়ের সর্বশেষ লেখা হলেও পাঠকরা আগে সেটি পড়ে নিবেন। কারণ বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের সংস্কৃতের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ির আবির্ভাব এই উপন্যাসেই। বয়স যাঁর পঁচাশি কিন্তু তন্ত্রবিদ্যা এখনো টনটনে।
উপন্যাসটি এককথায় বলতে নট ব্যাড। সবগুলো চরিত্রের উৎপত্তি ও সম্পর্ক সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ভিলেন হিসাবে গেনু আর লোকনাথ চক্রবর্তী দুর্দান্ত ছিল। গেনুর বর্ণনাটা ভীতিকর হলেও কল্পনায় আনা যায়না৷ হয়তো প্রচলিত ভারতীয়র বদলে আফ্রিকান পিশাচ হওয়ায়। তবে এই দুই ভিলেনের চরিত্রায়ণ দারুণ। বিশেষ করে ঢাকাইয়া ভাষার ব্যবহার। একটু হুমায়ুন আহমেদের ছাপ পেলাম।
কিছু মোমেন্ট যেমন সঞ্জয়ের মামাবাড়ি থেকে মৃত মামীর সাহায্যে পালানো, সমীরের বীভৎস মৃত্যু, তিতাসের তন্ত্রের স্পট খুঁজে পাওয়া, বাচ্চা শালিকের কান্ড- এগুলো সাসপেন্স তৈরী করেছে।
লেখক খুব সাবলীলভাবে এক সিন থেকে আরেক সিন এ মুভ করেছেন৷ খাপছাড়া লাগেনি। কাহিনীতে বিরক্তি আসেনি। স্মুদলি এগিয়েছে।
নেগেটিভ হিসাবে উপন্যাসে অপ্রয়োজনীয় যৌনতার ব্যাপারটা চোখে লাগছিলো। হয়ত লেখক গুরুত্ব বুঝাতে টেনেছেন, এটা হতে পারে। আধুনিক কলকাতার রাফ এন্ড টাফ ইয়ুথ, ওপেন সেক্স, লিভ টুগেদারের মত বিষয়ও এসেছে। কিছু জায়গায় পল্লব আর তিতাস ক্যারেকটার দুটোকে বিরক্ত লেগেছে।
ক্লাইমেক্সে মেজর কিছু হয়নি। লোকনাথ চক্রবর্তীর মত এত শক্তিশালী ও ইমপেক্টফুল ভিলেন গাড়ির এক ধাক্কাতেই মরে গেল। মানছি সে তখন শক্তিহীন ছিল, বাট তাকে কিছু স্পেস দেয়া যেতে পারত।
এদিকে গেনু বনাম ভাদুড়ি মশাই আর শেষে মৃত আত্নার দল দ্বারা গেনুকে হজম করা – এই দুটো জায়গা বেশ নাটুকে লেগেছে।
ভাদুড়ি মশাই এই উপন্যাসের মূল চরিত্র নন। তেমন ভূমিকা নেই। মূল চরিত্র লোকনাথ চক্রবর্তী আর গেনু। এক জাদুকরি ভিলেইনিতে পুরো নভেলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তারা। আর প্রোটাগনিস্টদের মাঝে প্রধান চরিত্র তিতাস। মেয়েটি যে দারুণ বুদ্ধিতে মিতুলকে বাঁচালো তা বাহবা দেয়ারই মত। একদম ‘পিরিয়ডিক’ বুদ্ধি!
বইটিতে দুটো ছোটোগল্প আছে। দেবী পর্ণশবরীকে নরবলি দিয়ে জাগায় এক প্রতিশোধপরায়ণ মহিলা – তারপর আশু নরকাগ্নি থেকে সমগ্র চটকপুর, সেইসাথে পাগলপ্রায় মিতুল ও তিতাস কে বাঁচাতে দেবীর মুখোমুখি হন ভাদুড়ি মশাই। গল্পটির ক্লাইমেক্সে পল্লব আর ভাদুড়িমশাইয়ের দেবীর সামনে আত্মাহুতি দেবার প্রতিযোগিতা আর সেইসাথে শেষমেশ দেবীর স্বরূপে আবির্ভাব – এই দুটো বর্ণনা দারুণ সাসপেন্সের। যেন মুভি দেখছিলাম।
তবে এপিলগটা হতাশাব্যাঞ্জক। আর যাই হোক অন্তর্যামী দেবীকে ঠকানো মানুষের কর্ম নয় – এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
হয়তো এই দুষ্কর্ম থেকেই পরবর্তী এডভেঞ্চার এর শুরুটা করবেন লেখক, তাই একটা ক্লিফহ্যাঙ্গার টাইপ রেখে দিয়েছেন।
সবচে ভালো লেগেছে ‘অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ’। ভাদুড়ি মশাইয়ের যৌবনকালের গল্প এটি। জলদাপাড়ায় গন্ডার পোচিং, মাথা গরম অফিসার বন্ধু, এক শয়তান তান্ত্রিক, মাকড়খাকি প্রেতের দল আর শেষে জঙ্গলের মহিষ দেবতা টাঁড়বারোর আবির্ভাব – সব মিলিয়ে ছোট গল্পটি দারুণ এগিয়েছে। তন্ত্র আর অরণ্য – দুয়ে একদম মিলেমিশে গলে গেছে।
গল্পে লেখক সমাজে পতিতাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। নীরেন ভাদুড়ির গুরুর মুখ দিয়ে বলানো লেখকের এ বক্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত।
নীরেন ভাদুড়ি সমগ্র (প্রথম খন্ড) – লেখক সৌভিক চক্রবর্তী, প্রকাশনায় – দীপ প্রকাশন। গায়ের মূল্য ৩০০/-।
সবমিলিয়ে ৩.৫/৫। দ্বিতীয় খন্ডের অপেক্ষায় রইলাম।
Leave a comment