ভ্রষ্ট সময়ে নষ্ট গল্প • এস এম নিয়াজ মাওলা
সময়টা ভালো যাচ্ছে না অন্তুর। বিয়ের পূর্বে রেমির সাথে ভালোবাসার যে একাত্ম সম্পর্ক ছিল; এখন আর তেমনটি নেই। নারীরা বলে, বিয়ের পর পুরুষদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। হয়তো সেই পরিবর্তন─অন্তুর মধ্যেও ঘটেছে! কিন্তু ‘ম্যাজিক’ গল্পে ঘটেছে ভিন্ন কিছু। সেই কিছুর একক অংশীদার একমাত্র অন্তু। পরিবর্তনের যে ধাপ─অন্তু তা চেয়েও অতিক্রম করতে পারেনি। অথচ পেরেছে রেমি। দোদুল্যমান এই শঙ্কায় আটকে থাকা অন্তু─পারছে না স্বাধীনতার দলিলে সাক্ষর করতে। যে সম্পর্ক তাদের একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল─সেটাই এখন দূরে ঠেলে দেওয়ার বাহকে রূপান্তরিত হয়েছে! এখন শুধু প্রয়োজন ম্যাজিকের! কী হবে সেই ‘ম্যাজিক’?
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দুটো ঘটনা─ঘটে যায় অরত্রীর জীবনে। সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পেতে অমিয়ের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়া। বিচ্ছেদ ছাড়া উপায়ও ছিল না অরিত্রীর হাতে। আট বছর বয়সি সামিন─যদিও বাবার ন্যাওটা। কিন্তু লালনপালনের দায়ভার অরিত্রী একাই নিয়েছে। ভালোবাসার এই বিবাহের সম্পর্কে হয়েছে কী? যার কারণে আলাদা হয়ে যেতে হয় অরিত্রী আর অমিয়কে? কিন্তু জোসেফ ও রিটার সম্পর্ক সহজ হয়েও কঠিন কেন? তাদের সাথে অরিত্রী আর অমিয়ের কী সম্পর্ক? তাহলে গল্পের ভেতর কি আরেকটি গল্প? এসব কিছুর উত্তর খুঁজতে হারিতে যেতে হবে ‘কষ্টের বালুচর’-এ।
ভালোবাসার এক কঠিন পরীক্ষায় হুট করে পড়তে হয় ব্যাংককে বেড়াতে আসা এক সাংসারিক পুরুষকে। ভালোবাসা দিবসে বৌ-মেয়ে থেকে দূরে একাকিত্ব যখন পেয়ে বসে; তখনই মেঘ না চাইতে জলের মতো ইংলাক নামক এক মেয়ের অবতারণা ঘটে। বডি ম্যাসেজের জন্য পরিচিত ব্যাংককে এমন সুবিধা পেয়েও একাকী থাকা পুরুষটি নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেনি। রোমাঞ্চকর এক শিহরণের আশায় ইংলাকের ডাকে যখন সাড়া দিয়ে বসে; তখন এক ‘নষ্ট গল্পের’ সূচনা ঘটে। যে গল্প ভালোবাসাকে পর্যবেক্ষণ করা শেখায়─দূরে থেকেও কাছে আসার আর কাছে থেকেও দূরে যাওয়ার।
লেখক উক্ত বইয়ে এমনই ১৫টি ছোটো গল্প দিয়ে সাজিয়েছেন। যার মধ্যে কিছু গল্পের কোনো সমাপ্তি নেই। অনেকটা ক্লিফহ্যাঙ্গারে আটকে রাখার মতো। আপনি চাইলে এর শেষটা অনুমান করে নিতে পারেন। দুটো অপশন লেখক দিলেও গল্পের প্রেক্ষাপটে তিনি ভালোবাসাকে বেশ প্রাধান্য দিয়েছেন। সম্পর্কের ভাঙন, ছেড়ে যাওয়া, পরকীয়ার মতো বিষয়গুলো যেন বাস্তব জীবন থেকে ধার করে লেখা। যদি ভেবে থাকেন শুধু একটা টপিক নিয়ে পুরো গল্প সংকলনটি লেখা─তবে তা আপনার ভুল ধারণা।
‘দৌড়’ নামক গল্পটি লেখক যেন ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর ছায়া অবলম্বনে লিখেছেন। যদিও সম্পূর্ণ নিজের মতো করে। ‘টার্নিং পয়েন্ট’ গল্পে লেখক সাইকোলজি নিয়ে এমন এক খেলা খেলেছেন; যা অবাক করে দেওয়ার মতোই। মনস্তাত্ত্বিক জনরায় এই ছোটো গল্পটি প্রশংসনীয়। থ্রিলারের ভাইব পুরোপুরি উক্ত গল্পে বিদ্যমান। ‘ভালোবাসা নয়, প্রেম’ একটি সুন্দর সম্পর্কের খারাপ লাগার গল্প। ‘নাথিং গোস আনপেইড’ যেন ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’ প্রবাদ বাক্যের মর্ম বুঝিয়ে দেয়। যে ব্যথা আজ আপনি অন্য কাউকে দিচ্ছেন; সেই একই ব্যথা আপনি নিজেও একদিন অনুভব করবেন। আর এটাকেই ‘শাস্তি’ বলে। শাস্তি যে কখনও সুখকর হয় না; এই গল্প সেটাই আরেকবার প্রমাণ করে।
প্রতিশোধের গল্প আর হারানো ভালোবাসার দুটো সুতো যে একই রেখায় জুড়ে দিবেন; তা ‘বোধোদয়’ গল্প না পড়লে জানা হতো না। ছোটো গল্প অথচ কী শক্তিশালী ভাবনা। মনস্তাত্ত্বিক ঘরনায় এই গল্পটিও দারুণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবর্ণনীয় অত্যাচারের কোনো দৃশ্য না থাকলেও, সেই সময়ে রাজাকারদের তৎপরতা এবং কিছু বছর পূর্বে তাদের দণ্ড কার্যকর হওয়া নিয়ে গল্প ‘বিচার’। এই গল্পটির থিম শক্তপোক্ত হলেও সমাপ্তি ঠিক জমেনি। লেখক হয়তো আরও কিছু যুক্ত করতে পারতেন উক্ত গল্পে। তবে যে বার্তা তিনি দিতে চেয়েছেন; তা সুস্পষ্ট। সামান্য গ্রিক মিথ নিয়ে ধারণা ও একজন রেবেকার অতীতের মর্মাহত কাহিনি নিয়ে সাজানো ‘রেবেকা এবং আমি’ ছোটো গল্পটি। এই গল্পের শেষটা ধাক্কা দিবে একইসাথে দারুণ কষ্টও। গল্পটি বোর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজিজে ভুগতে থাকা এক বালকের। ‘সুখীপুরের অসুখী গল্প’ আমাদের গ্রাম বাংলার প্রেক্ষাপটে ঘটমান এক অন্যায়ের গল্প। এই গল্পে সহানুভূতি কোনো চরিত্রের জন্য জাগে না। অন্যায়ের ফল কখনোই সুখ নিয়ে আসে না। এই গল্প সেটাই প্রমাণ করে দেয়।
‘ক্যাডাভার’ বলা হয় ডেড বডিকে; কিন্তু এই ডেড বডির জোগাড় কীভাবে হয় সেটা কি আমাদের জানা? হৃদয়বিদারক গল্পটি আপনার সত্তাকে দারুণ এক নাড়া দিবে। ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’ উক্ত সংকলনের সবচেয়ে সাহসী আর সত্য উন্মোচনের গল্প। লেখক একজন ডাক্তার হয়েও যে এমন এক বিষয়ে লিখবেন; তা ধারণার বাইরে। মৃত রোগীকে নিয়ে ব্যাবসা; ধর্ম ব্যাবসার মতো জমজমাট। আর লেখক এই গল্পে জীবন্মৃতের এক গল্প তুলে ধরেছেন। যারা জীবিত থেকে মূল্যহীন আর মৃত্যুর পর হয়ে যায় মূল্যবান। থ্রিলারের স্বাদ আবারও পেতে চাইলে ‘বায়না’ গল্প সংকলনের শেষ টোটকা। অল্পতে গল্প শেষ; থেকে যায় কাহিনির রেশ। গল্পটি গতানুগতিক হলেও উপস্থাপনা সুন্দর।
‘পরীক্ষা’ সংকলনের শেষ গল্প। লেখক হেনরি স্লেসারের ‘এক্সামিনার ডে’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে তিনি প্রোডিজি ঘরনার গল্পটি লিখেছেন। ইউনিক আর চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলার জন্য; অণুগল্পটি যথেষ্ট বলে মনে করি।
❛ভ্রষ্ট সময়ে নষ্ট গল্প❜ সংকলনটি এমন সব গল্প নিয়ে লেখা যা নিয়ে সহজে কেউ বলতে বা লিখতে চায় না। ৮৮ পৃষ্ঠার বইতে আপনি বাস্তবতা ও সমাজে চলমান যেসব অসংগতি রয়েছে; তার এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাবেন। ইতিবাচক ও নেতিবাচকের কথা উঠে আসলে বলব, উক্ত উপন্যাসে ছাপানো প্রতিটি গল্পের দুটো দিক রয়েছে। সেগুলো যদি যাচাই-বাছাই করে নেওয়া যায় তবে গল্পের মাহাত্ম্য আরও জোড়ালো হয়ে ধরা দিবে। যদিও অনেকের এই গল্প সংকলনটি গতানুগতিক মনে হতে পারে তবে সব লেখকের চিন্তাভাবনা যেমন এক না; তেমন সব পাঠকের বোঝার জ্ঞান একই না। একই গল্প আপনি যখন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে পড়বেন; মিল থাকলেও নতুন অনেক কিছু আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন। কেউ রাখঢাক করে লিখতে পছন্দ করে আবার কেউ খোলামেলা। এই খোলামেলার ধরন ❛ভ্রষ্ট সময়ে নষ্ট গল্প❜ সংকলনে প্রস্ফুটিত হয়েছে; যা ভালো লাগার অন্যতম দিক।
বইটিকে সাহিত্যের মানদণ্ড দিয়ে বিচার না করা ভালো। কারণ গল্প এখানে মূল আকর্ষণ; শব্দ বা বাক্যের ব্যবহারে যদি মুগ্ধ হতে চান─তাহলে কিঞ্চিৎ হতাশ হবেন। তবে সেই হতাশা গল্প দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন লেখক। চরিত্র গঠন বেশ ভালো। একেবারে মিশে যাওয়া যাকে বলে। কিছু বাক্য গঠনে সামান্য খাপছাড়া ভাব ব্যতীত ত্রুটির তেমন কিছু ছিল না। এক বসাতে এই সংকলন শেষ করা যায়।
লেখক এস এম নিয়াজ মাওলা-কে ভিন্ন এক লেখক অবতারে দেখতে ওনার এই গল্প সংকলন-সহ মিথলজি বাদ দিয়ে বাকি বইগুলো পড়া উচিত। লেখকের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা বেশ প্রখর; সাথে রয়েছে প্রগাঢ় দর্শন। বোধের দুনিয়া আরেকটু সহজ করে চেনাতে যা সহজ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে মজার দিকটি হচ্ছে, লেখকের সাইকোলজি আমার সাথে ভীষণ ম্যাচ করে। তাই অনুধাবনের প্রক্রিয়া অনেক বিস্তৃত হয়। আশা করি যারা পড়বেন; তারাও এই দিকটি উপলব্ধি করতে পারবেন।
‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত বইটির মুদ্রিত মূল্য ২০৪ টাকা। পড়ার যদি আগ্রহ হয় তবে নিয়ে নিবেন বিনা দ্বিধাবোধে ভুগে। A credit of Peal Roy Partha
Leave a comment