মৃত্যুর পেলব স্পর্শ | রাফাত শামস

  • বই : মৃত্যুর পেলব স্পর্শ | রাফাত শামস
  • জনরা : নারকোটিক্স থ্রিলার
  • প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২১
  • প্রচ্ছদ : ফরিদুর রহমান রাজীব
  • প্রকাশনা : অবসর
  • মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা মাত্র

❛মৃত্যুর পেলব স্পর্শ❜ বইটিকে ক্রাইম থ্রিলার জনরায় ফেললেও এটি মূলত নারকোটিক্স থ্রিলারের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজি ‘নারকোটিক’ শব্দের বাংলা অর্থ চেতনানাশক মাদকদ্রব্য। এই নারকোটিক্স বা মাদকদ্রব্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অহিফেন বা আফিম বাংলায় যেটাকে আমরা ‘পপি’ নামে বেশি পরিচিত। এই মাদকদ্রব্য নিয়ে অনেক যুদ্ধ, সে-ই যুদ্ধ থেকে আইন প্রণয়ন এরপরে অবৈধ ট্যাগ। মাদকদ্রব্য চোরাকারবারি থেকে যত ধরনের অপরাধমূলক কাজ রয়েছে সেইসব কিছুর সাথে জড়িত রয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, ড্রাগ লর্ড কিংবা সম্রাট পদবিধারী মানুষরা। অপরাধ জগতের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনাগুলো যখন বৃহদাকার রূপ ধারণ করে সেটার মূল কারণও এই মাদক।


লেখক মাদক, ড্রাগ লর্ড আর এসবের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলা আইনি বাহিনী নিয়ে গঠিত ❛মৃত্যুর পেলব স্পর্শ❜ উপন্যাসিকা। কাহিনির গড়পড়তা কম হলেও তুলে এনেছেন বিশেষ কিছু চিরাচরিত দৃশ্য। যেহতু প্লট পুরোপুরি সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিভীষিকাময় এক জগতের, সেখানে গড়ে ওঠা হিংসা, ক্ষমতা লড়াইয়ের খেলা, প্রতিশোধ সবকিছু মিলিয়ে উপভোগ্য কাহিনি গঠনে তেমন কমতি না থাকলেও সামান্য অপূর্ণতা থেকে গিয়েছে।


➲ আখ্যান—
সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরেক সমাজ। সেখানে চলে না প্রচলিত নিয়মকানুন। লাশের পর লাশ ফেলে দেওয়া হয়, হাতবদল হয় কোটি কোটি টাকা। নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িয়ে এই অন্ধকার জগতের মানুষেরা আমাদের সমাজে সৃষ্টি করে গভীর সব ক্ষত। বাজারে এল নতুন এক মাদক। অন্ধকার সাম্রাজ্যে বেধে গেল যুদ্ধ। সেই চক্রবূহ্যে হিমশিম খেতে লাগল একদল সত্য সন্ধানী মানুষ…


➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—
বইটিতে আপ টু দ্য মার্ক তেমন কিছু নেই, গতানুগতিক ক্রাইম, মার্ডার বেসড কাহিনি হলেও ইন্টারেস্টিং হচ্ছে চরিত্রায়ন। ‘টাল্টু’ নামক ড্রাগটির বইয়ে ফোকাসে ছিল যেহেতু এই ড্রাগ নিয়ে এতসব ঘটনা, আর ঘটনা থেকে সাপে নেউলে লড়াই। কে কালপ্রিট আর কেই-বা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে সেটা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে শেষ পাতা পর্যন্ত। টান টান উত্তেজনা না হলেও গল্পে মজে থাকার মতো সিকুয়েন্স ছিল। টুইস্ট ভালো ছিল, তবে একটু বেশি দ্রুত ঘটে গেল মনে হলো সবকিছু। লেখক আরও কিছু দিতে পারত পাঠককে।


● প্রারম্ভ—
গল্পের শুরুটা হয় এএসপি সাজ্জাদের একটি গুদামঘরের রেড, ফার্মাসিউটিক্যালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ফজল সাহেবের ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার কারণ এবং পথের রাজাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে কাহিনির ডালপালা মেলতে থাকে। বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস, খুনের স্পট, বিলাসবহুল গাড়ির ব্যাক সিট, গোলাগুলি পর্যন্ত এই ডালপালার বিস্তৃত। গল্পের শুরুটা কিছুটা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও একেবারে খাপছাড়া লাগেনি। কিছুটা ধৈর্য নিয়ে বসতে মূল কাহিনি ঘটার জন্য। তবে জাম্পিং ছিল অনেক।


● গল্প বুনন—
গল্প বুননে লেখকের পারদর্শিতা আরেকটু বেটার হলে ভালো হতো। সিকুয়েন্স সাজানো ঠিকঠাক হলেও হুটহাট সবকিছু ঘটে যাওয়ার কারণে ঘটনার রেশ নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছিল। গ্রিপিং কম ছিল। গল্প বলার ভঙ্গিমা সাবলীল লেগেছে।


● লেখনশৈলী—
সহজ বাংলা শব্দের পাশাপাশি বেশ ইংরেজি সংলাপ সাথে আইনি কার্যালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম আসা-যাওয়া করাতেও লেখনশৈলীতে ভাটা পড়েনি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, বিলাস বহুল গাড়ির আলোচনা, গোলাগুলির জন্য ব্যবহৃত কয়েক প্রকারের অস্ত্রের বর্ণনা সবকিছু সহজভাবে ফুটে উঠেছে প্রাঞ্জল লেখনশৈলীর কারণে।


● বর্ণনাভঙ্গি—
❛মৃত্যুর পেলব স্পর্শ❜ উপন্যাসিকাতে প্লট ও চরিত্রের গুরুত্ব প্রায় সমানুপাতিক ছিল। বিভিন্ন চরিত্রের কার্যক্রম ও পারিপার্শ্বিক বর্ণনাতে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। পাঠক সিকুয়েন্সগুলো বেশ ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবে। কঠিনভাবে কোনো বস্তুর বা ব্যক্তির বর্ণনা দেওয়া হয়নি। লেখক অল্পতে অনেককিছু সহজে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে৷


● চরিত্রায়ন—
কাহিনিতে ডুবে যাওয়ার একটি চরিত্রের ভূমিকা অনেকাংশে দায়ী। লেখক চরিত্র বানানোর পেছনে শ্রম দিয়েছেন। শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান, চৌকস এইরকম অনেক চরিত্রের সমারোহ ঘটেছে। মুহূর্তে শক্তিশালীর চরিত্রের পতনের পাশাপাশি বলশালী চরিত্রের আবির্ভাব কাহিনিতে অনেক শক্তি যুগিয়েছে। প্লট বিল্ডাপ থেকেও চরিত্র বিল্ডাপে লেখক এগিয়ে রয়েছেন৷


প্রত্যকটা চরিত্রের ইমেজ পরিষ্কার তবে কিছু চরিত্রের ব্যাকস্টোরি আরও শক্তিশালী হতে পারত। লেন্থ কম মনে হয়েছে। আশা করি সিক্যুয়েলে সেগুলো পুষিয়ে দিবে, তবে মূল চরিত্রগুলো নিয়ে প্রথম বইতে বিস্তারিত আলোচনা করলে বেটার মনে হয়।


● সমাপ্তি—
টপাটপ যেভাবে লাশ ফেলে দেয় কোনো দুরন্ত শার্প শুটার সেইভাবে লেখকও কয়েকটি ঘটনা টপাটপ ঘটিয়ে ফেলেছেন। একটা দরজা দিয়ে যখন কয়েকশ লোক একসাথে ঢোকার চেষ্টা করে বিষয়টি অনেকটা সেইরকম। তবে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে সেটার ব্যাখা দাঁড় করিয়েছেন লেখক। তবে সাসপেন্স ক্রিয়েট করার জন্য যেটুকু সময় নেওয়ার দরকার ছিল সেটা মিসিং। পুরো গল্পটা দ্রুতগামীর হলেও শেষে কিছুটা ধীরগতিতে চালালে ব্যাপারটা আরও সুন্দর হতো। সবমিলিয়ে সমাপ্তি ভালো, পুরো ঘটনার টীকাটিপ্পনী সুদে-আসলে ফেরত দিয়েছেন লেখক।


● খুচরা আলাপ—
❛মৃত্যুর পেলব স্পর্শ❜ কাহিনি গ্রিপ করার জন্য খুনের বর্ণনা ও সেগুলো নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত তদন্ত দেখালে আশানুরূপ হতো। পথের রাজাদের বললেও কাহিনি ফোকাস হয়েছে একটি খুনের দিকে, সে-ই খুন ঘিরে চরিত্রগুলো সাজানো। সাজ্জাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে ক্লিয়ার হয়নি যেহেতু গল্পে সে মূল প্রোটাগনিস্টের একজন। ডেপথ কম লেগেছে। নারকোটিক্স থ্রিলারগুলো বড়ো কলেবরের হলে তখন তৃপ্তি বেশি পাওয়া যায়। শুরু হওয়ার আগে কাহিনি শেষ হলে কিছুটা আক্ষেপ হয়।


➢ লেখক নিয়ে কিছু কথা—
রাফাত শামস ভাইয়ের প্রথম বই ‘বাণ’ যেটা পড়া হয়নি। ❛মৃত্যুর পেলব স্পর্শ❜ বই দিয়ে ওনার সাথে যাত্রা শুরু। যেহেতু বইটির আরও সিক্যুয়েল আসতে চলেছে তাই আশা করি আরও জম্পেশ প্লট ও স্টোরির দেখা পাবো। শুরুটা ভালো ছিল।


● সম্পাদনা ও বানান—
২৩ পৃষ্ঠায় ফজল চরিত্রের সাথে আননোন একজনের সাংকেতিক আলোচনায় ‘বিড়াল’ নিয়ে কথা না হলেও সেটা উল্লেখ ছিল। যেটা অপ্রয়োজনীয় অথবা টাইপো।


৩২ পৃষ্ঠায় ইব্রাহিম হাশিম চরিত্রের নাম কয়েকবার ‘ইব্রাহিম আনসারি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
এছাড়া কয়েক জায়গায় ‘ইউ’ হয়ে গেছে ‘উই’। তাছাড়া নিত্যব্যবহার্য কিছু বানান ভুল রয়েছে। এল, দিল এইসব শব্দে ‘ও-কার’ ব্যবহার করা উচিত ছিল।


● প্রচ্ছদ—
ভিডিয়ো গেমগুলোর জন্য যেইরকম রেট্রো টাইপ প্রচ্ছদ তৈরি করা হয় এই বইয়ের প্রচ্ছদ অনেকটা সেইরকম। কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ভালো লেগেছে


● মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা—
মলাট শক্তপোক্ত হলেও বাঁধাই দুর্বল। যদিও বই পড়তে কোনো সমস্যা হয়নি তবে কয়েকবার পড়লে ফর্মা থেকে পেজ ছুটে যেতে পারে। বাকি ফন্ট, লাইন গ্যাপ সব ঠিকঠাক।
Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *