“মেঘ বিষাদের গল্প”
নামের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিষাদের সুর। যেখানে মেঘ ভেসে বেড়ায়, কখনো কোনো ক্লান্তিকর সময়ে ঝরে বারিধারা হয়ে। আমাদের জীবনটাও মেঘের মতো। বিশাল আকাশের মতো জীবনের পথেঘাটে ভেসে বেড়ায়। একটু আঘাতে ঝরে বৃষ্টি হয়ে। কখনো দু’চোখ বেয়ে দৃশ্যমান, কিংবা মনের কোণে অদৃশ্য হয়ে থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।
▪️কাহিনি সংক্ষেপ :
শাওন ছেলেটা বাউন্ডুলে। বাবা হারানো শাওন পরিবারের বড়ো ছেলে হয়েও কিছু করে না। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। এ নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ছেলে কিছু একটা করে থিতু হবে, এই আশা সব মা-ই করে। শাওনকে নিয়েও তার মায়ের একই ইচ্ছা। এরপর বিয়ে দিয়ে দিয়ে ছেলেকে সংসারী করতে হবে। পাত্রী দেখা আছে। শাওনের মামাতো বোন রানু। শাওনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে রানু। বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। দু’জনের স্বপ্নের ব্যাপ্তি বিশাল। এই বিশালতায় হারিয়ে যেতে হবে না তো?
শাওন যেদিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, সেদিকে দায়িত্ববান তারই ছোটো ভাই বাদল। একাই সংসারের হাল ধরে বসে আছে। অবশ্যই সৎপথে নয়। গুন্ডামি, মাস্তানি, টেন্ডারবাজি করে দিন কাটানো বাদল পেল বড়ো একটি প্রস্তাব। এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে মারতে হবে। কোনোদিন খুন না করা বাদল টাকার অংক শুনে না করতে পারল না। ঘটনার দিন ছোট্ট ভুল করে ফেলল বাদল। ব্যবসায়ীর বদলে খুন হয় তারই ছয় বছরের মেয়ে নিধি। বাদল এমনটা চায়নি। একটি শিশুকে খুন করে অনুতপ্ত বাদল পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কীভাবে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে সে জানে না।
মেয়েকে হারিয়ে হায়দার সাহেব হিংস্র হয়ে উঠেছেন। যে করেই হোক মেয়ের খুনিকে শাস্তি দিতে হবে। পুলিশ কিছু করতে না পারলে নিজে করবে। অতীতে রাজনীতির অভিজ্ঞতা আছে। মেয়েকে হারিয়ে আবার সেই রাজনীতির পথ ধরছেন। হয় এসপার, নয় ওসপার। যে করেই হোক বাদলকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু খুঁজবে কোথায়?
বাদলের দেখা হলো তৃণার সাথে। তৃণা কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছে? না-কি বাচ্চা বয়সের মায়া? শাওনের প্রতি রেনুর অনুভূতিটা কীসের ইঙ্গিত করে? শাওন কী করবে? শাওনের বন্ধু জসিম কিংবা মান্নাফের গল্প আলাদা। এই গল্পটা শাওন, বাদলের কিংবা বৃষ্টির। কিংবা রেনু, মিন্টু বা রিন্টুর। অথবা ছোট্ট নিধির। যার দুচোখ জুড়ে পৃথিবী দেখা হলো না। গল্পটা হয়তো আনন্দের কিংবা প্রতিশোধের। সবশেষে বিষাদের।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
একজন লেখকের সবচেয়ে বড়ো গুন কী? তিনি পাঠককে ধরে রাখতে পারেন। পাঠকের অনুভূতিতে আঘাত করতে পারেন। লেখক শরীফুল হাসানের এই গুনটি খুব ভালোভাবেই আছে। তিনি যেভাবে লিখেন, পাঠক পুরো সময় বইয়ের সাথে একটি বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে। একটি সাদামাটা প্লটকে দারুণ উপভোগ্য করে তোলার ক্ষমতা সবার থাকে না।
আমি অনেক জায়গায় বলেছি, আমি লেখকের বর্ণনার অনেক বড়ো ভক্ত। এই ভক্তি তার লেখা পড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবকিছু প্রানবন্ত মনে হয়। ছোটো ছোটো বর্ণনায় সবকিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন খুব ভালোভাবেই।
“মেঘ বিষাদের গল্প” বইয়ের শুরুতে লেখকের লেখা কিছুটা হুমায়ূন আহমেদ ধাঁচের মনে হয়েছিল। পরবর্তীতে লেখক স্বমহিমায় উজ্জ্বল। খুব সাদামাটাভাবে লেখক গল্প বলে গিয়েছেন। আর গল্প বলাতেই কাহিনি এগিয়েছে তরতর করে। দারুণ গতিশীল বই। মেদহীন, বাহুল্য বর্জিত বইটি পড়তে বিন্দুমাত্র বিরক্তিবোধ হয়নি।
“মেঘ বিষাদের গল্প” উপন্যাসটি সামাজিক উপন্যাস জনরার হলেও, কিছুটা থ্রিলার অনুভূতি দিয়ে যায়। এতে খুন আছে। খুনির পিছনে দৌড়ানো আছে। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত কিছু মানুষ আছে। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হওয়া মানুষ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত এই উপন্যাসটি। প্রতিশোধের আগুন সবকিছু ভস্ম করে দেয়! ছয় বছরের একটা বাচ্চাকেও ছাড়ে না।
এই বইয়ের শেষটা অদ্ভুত সুন্দর। কোনো বইয়ের শেষটা হয় বিষাদে মোড়া থাকে, কিংবা ভীষণ আনন্দের। এই বইয়ের শেষটা ঠিক আনন্দে শেষ হলো, না বিষণ্ণতায় শেষ করলাম ঠিক বুঝতে পারলাম না। একদিকে তৃপ্তি লাগছে, আবার মনে হচ্ছে এভাবে শেষ না হলেও পারত। মিশ্র এক অনুভূতি ঘিরে ধরছে। এই অনুভূতি ঠিক কেমন, তা বলে বোঝানো যায় না।
▪️চরিত্রায়ন :
লেখক চরিত্রায়নের দিকে খুব ভালো নজর দিয়েছেন। ছোটো ছোটো চরিত্রকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই জন্য লেখকের তারিফ করতেই হয়। খুব বেশি কিছু বর্ণনা নেই, তবুও প্রতিটি চরিত্রের মূল্য উঠে এসেছে তার লেখায়।
“মেঘ বিষাদের গল্প” বইয়ে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে লেখকের এই চরিত্র নিয়ে খেলা। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আসলে কে? কখনো মনে হবে শাওন অথবা বাদল। আবার রেনু, তৃণা, রিন্টু, মিন্টুরাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিংবা হায়দার আলীও। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট নিধিকেও ভুলে গেলে চলবে না। না থেকেও পুরোটা সময় ছিল সে।
সচরাচর কোনো বইয়ে এভাবে সব চরিত্রকে গুরুত্ব দিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখা যায় না। “মেঘ বিষাদের গল্প” উপন্যাসে এই বিষয় দেখে ভালো লেগেছে। সবার গুরুত্ব সমানভাবে ছিল। একজনও না থাকলে হয়তো উপন্যাসটি পূর্ণতা পেত না।
▪️সম্পাদনা ও প্রচ্ছদ :
“মেঘ বিষাদের গল্প” বাতিঘর প্রকাশনীর আগের বই। সে হিসেবে বানান ভুল, ছাপার ভুল, সম্পাদনার অভাবের আধিক্য ছিল। খারাপ লাগে যখন সাধারণ কিছু বানানের ভুল পরিলক্ষিত হয়। যেমন : কারণ, পড়া/পরা, কী/কি… এসব কারণে অর্থ বিভ্রাটের সুযোগ থাকে।
বইয়ের এক জায়গায় লেখা ছিল, রেনুর কলেজ বন্ধ। তার পরক্ষণেই লেখা, রেনুর কলেজে যেতে ইচ্ছা করছে না। কোনটা ঠিক বা ভুল জানি না। এগুলো সম্পাদনার ত্রুটিকেই মনে করিয়ে দেয়। এ নিয়ে বেশি কিছু বলারও নেই অবশ্য। আর কত বলা যায়?
সাদামাটা প্রচ্ছদটা বেশ ভালো লেগেছে। সাথে প্রোডাকশন চলনসই।
▪️পরিশেষে, লেখক শরীফুল হাসান এক সময় সামাজিক উপন্যাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন বলে আমার বিশ্বাস। সম্প্রতি তার রচিত সবগুলো সামাজিক উপন্যাস পাঠক প্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার সবচেয়ে পছন্দের বই “বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ” একটি মাস্টারপিস। “মেঘ বিষাদের গল্প”ও ভীষণ ভালো লেগেছে। সামনে লেখকের কাছ থেকে আরও দারুণ সব কাজ প্রত্যাশা করছি। আশা করি নিরাশ হবো না।
▪️বই : মেঘ বিষাদের গল্প
▪️লেখক : শরীফুল হাসান
▪️প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী
▪️পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৯১
▪️মুদ্রিত মূল্য :২২০ টাকা
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪/৫
Leave a comment