“মোহমেঘ” শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক রহস্য। আকাশে ঘন কালো মেঘ দানা বাঁধে ক্ষনিকের জন্য ৷ কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল নিমিষেই কাটিয়ে দেয় কালচে মেঘ। আকাশ ফিরে পায় তার পূর্বের ঝকঝকে রূপ।
সমকালীন লেখিকা শারমিন আঞ্জুম এর রচিত “মোহমেঘ” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তরুর জীবনেও আসে সেই কালচে মেঘ। একসময় তরু বুঝতে পারে, ভালোবাসা নামক মোহের জালে সে আটকে ছিল দীর্ঘসময়। একটি সত্য তার মোহমেঘ কাটিয়ে দেয় পুরোপুরিভাবে।
প্রচ্ছদকাহিনী :
বইয়ের প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গল্পের প্রধান চরিত্র তরুকে। মোহাচ্ছন্ন তরুর সংগ্রামের কথা যেন ছবিটিই বলে চলছে অনবরত।
গল্পকথন :
খুব অল্প বয়সেই তরুর বিয়ে হয় ডাক্তার ফেরদৌসের সাথে। তাদের দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না এক বিন্দু। কিন্তু সুখের সংসারে সন্তানহীনতা এক চিমটি অসুখ বয়ে আনে। স্বামী ফেরদৌসের তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই৷ স্ত্রীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় আচ্ছন্ন সে। প্রয়োজনে বাচ্চা দত্তক নেবে৷ তবুও স্ত্রীকে ছাড়া বা আরেকটি বিয়ে করার কথা সে ভাবতেও পারে না। কিন্তু ফেরদৌসের মা একজন বন্ধ্যাকে কখনোই মেনে নেবেন না বলে পণ করেন৷ ত্রুটি যেখানে তরুর সেখানে এতিম কোনো বাচ্চাকে বংশেরবাতি হিসেবে মানতে তিনি নারাজ। পারিপার্শ্বিক জটিলতা একসময় তরু এবং ফেরদৌসের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছাড়ে। গল্পের শুরু সেখানেই…
চরিত্রকথন :
তরু :- লেখিকা শারমিন আঞ্জুম এর লেখার বিশেষত্ব হচ্ছে নারী জীবনকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা। “মোহমেঘ” তার ব্যতিক্রম নয়। নারী চরিত্র তরু বাস্তব জীবনে অসংখ্য নারীর উপমা। সন্তানহীনতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে নারীর অবস্থান সমাজের চোখে কোথায়। প্রতিটি পদে পদে হেনস্তার শিকার হয়েও দমে যায়নি তরু৷ আত্মসম্মানকে সর্বোচ্চ চূড়ায় রেখে লড়ে গেছে সমাজের সাথে, নিজের মনের সাথে।
ফেরদৌস :- স্ত্রীকে চরম ভালোবাসতে জানা ফেরদৌস স্ত্রীকে সম্মানিত করতে জানে না। দীর্ঘদিন ধরে নিখুঁত কৌশলে সমাজের সামনে নিজ স্ত্রীকে ত্রুটিযুক্ত করে তুলেছে নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে। সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে শুধু ভালোবাসাকেই জাহির করে গেছে। অথচ মূল ভিত্তি বিশ্বাসই ছিল সেখানে ভঙ্গুর।
সামের :- প্রকৃত প্রেমিকের এক উদাহরণ সামের। তরুণ জীবনের প্রেমকে মনে পুষে রেখেছে বছরের পর বছর। হঠাৎ আকাঙ্খিত ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষীণ আশা উদয় হতেই নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পরে নতুন উদ্যোমে। ভালোবাসার মানুষকে বৈধ করে পাওয়ার পরেও তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত অবকাশ দিয়ে গেছে। তার এই অনন্য বৈশিষ্ট্যই তাকে একসময় সফলকাম করে তোলে।
এছাড়াও রয়েছে পুত্রবধূকে শুধুই বংশরক্ষক হিসেবে গণ্য করার মতো মানসিকতা সম্পন্ন একজন শাশুড়ি। রয়েছে সমাজের কীটস্বরূপ হায়দার। যার নেশা ও পেশা পরনারীতে আসক্ত হওয়া, নারীকে ভোগবস্তু মনে করে হেনস্তা ও লাঞ্চিত করা।
পাঠপ্রতিক্রিয়া:
গতানুগতিক ধারার বাহিরে একটি টান টান উত্তেজনামূলক বই পড়লাম। কাহিনীর ভাজে ভাজে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। পরবর্তী মোড় ধরার কোনো সুযোগ রাখেননি লেখক। আসল রহস্যকে উন্মোচন করতে পাঠককে যেতে হবে গল্পের শেষ অবধি। শেষটা জানার পর পিলে চমকে চোখ স্থির করে ভাবতে হয়েছে এটা কি ছিল!
এছাড়া বইটিতে উঠে এসেছে বেশকিছু মেডিকেল টার্ম৷ যা সাধারণ মানুষের জানাশোনার বাইরে। সেসবকে বইয়ের পাতায় ফুটিয়ে তুলতে লেখকের বাড়তি যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
প্রকাশনী সম্পর্কে মতামত :
উপকথার প্রথম সফলতা “মোহমেঘ”। আর “মোহমেঘ” এর দ্বারাই উপকথার প্রথম বই পড়া আমার৷ প্রথম বই হিসেবে প্রডাকশন খুবই ভালো ছিল। বইয়ের বাঁধন বেশ শক্তপোক্ত এবং বানান ভুল জনিত সমস্যা তেমন চোখে পড়েনি। আশা রাখছি উপকথা প্রকাশনী এভাবেই এগিয়ে যাবে শীর্ষের দিকে।
রেটিং :- ৯.৫ / ১০
বই সম্পর্কিত তথ্য
————————-
বইয়ের নাম :- মোহমেঘ
লিখেছেন :- শারমিন আঞ্জুম
প্রচ্ছদশিল্পি :- সাদিত উজ্জামান
প্রকাশনী :- উপকথা
মুদ্রিত মূল্য :- ৩০০ টাকা
Leave a comment