শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব
➤মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে আবার নতুন করে মানুষ হতে হয়! তার ভেতরে যে মনুষ্যত্ব আছে, শিক্ষা দিয়ে তা বের করে আনতে হয়।
কথায় আছে- “প্রাণ থাকলে প্রাণী হয় কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না”। এটা থেকে বুঝা যায় যে, সব মানুষের মধ্যে মানবসুলভ মন থাকেনা, এটি তৈরি করতে হয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে।
☞☞শিক্ষাঃ
➤’Education’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত কয়েকটি অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘to lead out’ অর্থাৎ বের করে আনা, যা কিনা একজন মানুষের মধ্যে থাকা মনুষ্যত্ববোধ কে জাগ্রত করার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করছে।
শিক্ষার সাথে মানুষের সম্পর্ক নিবিড়, যা কিনা মনুষ্যত্ব অর্জনের পথ দেখিয়ে মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে।
শিক্ষা প্রসঙ্গে মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, “শিক্ষা কোনো ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মিথ্যা থেকে সত্য,অবাস্তব থেকে বাস্তব,কল্পনা থেকে প্রকৃত কে আলাদা করতে সক্ষম করে তোলে”।
☞☞ মনুষ্যত্বঃ
➤রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ” মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে মানুষ ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা,প্রথার দ্বারা নয়-এটাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব’। আর আমাদের এই মনুষ্যত্ব অর্জনের পাথেয়ই হচ্ছে শিক্ষা।
মানুষ হওয়ার জন্য একজন মানুষের অস্তিত্বে মনুষ্যত্ববোধ থাকা প্রয়োজন। একজন মানুষ কখনই তার মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ না ঘটিয়ে নিজেকে মানবসত্তার অংশ হিসেবে পরিচয় দিতে পারেনা, আর না পারে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে।
☞☞শিক্ষার উদ্দেশ্যঃ
➤শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করা, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তাকে মানুষের মতো মানুষ হতে সাহায্য করা।
জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। মনুষ্যত্ব ছাড়া মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারেনা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার এই মহৎ উদ্দেশ্য আদৌ কি ফলপ্রসূ হচ্ছে? আমরা মনুষ্যত্ব চর্চার দ্বারা আসলেই প্রকৃত মানুষ হতে পারছি কি?
☞☞একটা দৃশ্যপট কল্পনা করা যাক,,,
একই এলাকার দুজন ব্যক্তি একই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে একই পেশায়- শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্রের দিক দিয়ে দুজন দু’মেরুর লোক। একজন নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের থেকে অবৈধভাবে টাকা নিচ্ছে আর অন্যজন তার দায়িত্ব অত্যন্ত সততার সাথে পালন করছে।
কিন্তু একই পরিবেশে, একই শিক্ষা পেয়েও কেন দু’জনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ধাঁচের? একজনের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের ছিঁটেফোঁটাও নেই, আর অন্যজন নিতান্তই একজন ভালো মানুষ।
এখানে দু’জন ব্যক্তির উদাহরণমাত্র। এমন শতশত উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে।
কিসের কমতি ছিল? কোথায় গ্যাপ ছিল?
হ্যা, গ্যাপ তো একটা ছিলই! সেটা হচ্ছে, মানুষ কিভাবে শিক্ষাকে নিচ্ছে সেই সাথে শিক্ষার উদ্দেশ্য ঠিক রাখছে কিনা- এই দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন না হলে মানুষ প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে, ব্যাঘাত ঘটবে নৈতিক গুণাবলির চর্চাতেও।
☞☞তথাকথিত শিক্ষা গ্রহণঃ
➤আকার-আকৃতি, রঙে-ঢঙে মানুষ পৃথক হতে পারে কিন্তু তাদের মধ্যে থাকা মনুষ্যত্বের উপাদান অর্থাৎ মানবীয় গুণগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই গুণাবলির জন্যই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে। মানুষের চেতনায়, প্রতিভায় এগুলো সুপ্ত থাকে- যেগুলো বের করে আনতে হয় শিক্ষার মাধ্যমে।
কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে আমরা শিক্ষার উদ্দেশ্যের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা কি জন্যে শিক্ষা গ্রহণ করছি নিজে থেকে সেটার উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলি, যারজন্য আমরা প্রকৃত শিক্ষার স্বাদ পাইনা। নিজেদের উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে তথাকথিত শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিত মানুষ হওয়ার ট্যাগ ঠিকই অর্জন করি কিন্তু প্রকৃত মানুষ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারিনা!
☞☞ভুল উদ্দেশ্যে শিক্ষা গ্রহণঃ
➤শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় এখন আর মনুষ্যত্ব অর্জনের বিষয়টি আসেনা। আমাদের লক্ষ্য থাকে সার্টিফাইড হবার দিকে!
নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার বিষয়টি মাথায় আসলেই মনে হয়- এসব কেউ এখন দেখে না, কেউ তো আর ভালো মনের খোঁজ নেয় না, আর না করে ভালো মানুষের খোঁজ।
ভালো সিজিপিএ থাকলেই হলো,দিনশেষে একটা ভালো চাকরি হলেই তো ‘স্টাবলিশ ম্যান’ ট্যাগ লাগানো যায়! প্রচুর পড়তে হবে- ঘূণে খাওয়া, পোকায় ধরা, ধুলোবালির আস্তরণে ডুবে যাওয়া বই পড়তেও আমাদের আলসেমি নেই! থাকবে কেন?
আমাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রিসার্চার হতে হবে যে!
আমার মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে যে!
কেউ এককাঠি সরেশ- ভালোবাসার মানুষকে পেতে হলেও প্রচুর পড়তে হবে!
বাহ! কি সুন্দর উদ্দেশ্য শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের।
☞☞মনুষ্যত্বের অবমাননাঃ
➤আজ আমাদের শিক্ষাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মাইন্ডসেটিং যখন এমন- তখন সেখানে কিভাবে আমরা যথাযথ মানুষ হয়ে বাঁচার মতো দুঃস্বপ্ন দেখি!
যুগে যুগে এভাবেই মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়ে আসছে, মানুষ শৃঙ্খলার বাঁধন খুলে সর্বত্র অস্বাভাবিক বিচরণ করছে- যার ফলে হিংসা, সংঘাত, অরাজকতায় এই সুন্দর পৃথিবী জর্জরিত হয়ে ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে!
➤বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, “দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য”।
আমরা যেন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে চিন্তার সৌন্দর্য কে ফুটিয়ে তুলতে পারি। এর উদ্দেশ্য হোক, বিকাশমান আত্মসত্তার অধিকারী মানুষের সম্পূর্ণ বিকাশ সাধন, হোক সুস্থ দেহে সুন্দর মানসিকতা তৈরি করা!
পৃথিবীতে আমাদের বিচরণ হোক অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক পুরো মানব সভ্যতা, পৃথিবী তার সজীবতা ফিরে পাক মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষের পদধূলিতে।
শিক্ষা হোক আমাদের মুক্তির পথ!
-লাবনী
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
Leave a comment