বইঃ শ্রেষ্ঠ গল্প
লেখকঃ এডগার এলান পো
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬৪
প্রকাশনীঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
এলান পো একজন বিশ্ব বিখ্যাত কবি ও গল্পকার। তিনি হলেন প্রথম গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। মাত্র তিনটি গল্পে অগাস্ত দ্যুপো চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি যে জনরা সৃষ্টি করেছেন তারই উত্তরসূরী হলো শার্লোক হোমস। তার গল্প কবিতায় রয়েছে রহস্য আর বিভীষিকার এক অন্য জগত যা সময় কালের উর্ধ্বে গিয়ে অন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করেছে। বাংলাসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এ ব্যাপারটি লক্ষণীয়। আর এদিকটায় আলোকপাত করেই আব্দুল মান্নান সৈয়দ বনলতা সেন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “জীবনানন্দের কোনো কোনো কবিতা এলান পো—এর স্থানকালাতীত সুন্দরচর্যার মতোই অতিক্রম করে যায় পৃথিবীদৃঢ় স্থানকালসীমা : ধূসর, বিজন, রহস্যময়, অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত জগৎ নির্মাণে উভয়ে পরস্পরের উপবর্তী।” পো-এর জীবনে দুঃখ দুর্দশা দারিদ্র আর প্রেমে ব্যর্থতা খুবই প্রকটভাবে তার লেখার মধ্যে প্রভাব ফেলে। তার গল্পগুলোর মতোই তার মৃত্যুটাও ছিলো অতিপ্রাকৃত আর রহস্যময়। পো-এর সংক্ষিপ্ত জীবন আর কর্মজীবন নিয়ে আহমাদ মাযহারের ছোট্ট রচনাটি বইয়ের শুরুতেই পাবেন।
সাতটি গল্প নিয়ে এই সংকলন। এই বইয়ের প্রতিটি গল্পই পো-কে অমর করে রাখবে। বিশেষ করে এখানকার তিনটি গল্প ‘লাল মড়ক’, ‘আশার বংশের পতন’ আর ‘কালো বিড়াল’ জগদ্বিখ্যাত।
প্রথম গল্প ‘ভ্যালডিমারের মৃত্যু’তে আমরা দেখব একজন মৃত্যুপথযাত্রীকে সম্মোহনের মাধ্যমে জীবিত রাখার এক ভয়াবহ উপায়। গল্পের নায়ক একটা পরিক্ষা চালায়। সম্মোহনের মাধ্যমে মৃত্যুকে বিলম্বিত করা যায় কি না দেখতে। দেখা যায় ভ্যালডিমার মরে যাওয়ার পরেও সম্মোহনের বলে কথা বলে যায়। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটি ঘটে শেষ মুহূর্তে যখন তার থেকে সম্মোহনের প্রভাব সরানো হয়। পো-এর গল্পগুলাতে উপসংহারগুলো খানিকটা একই রকম থিম দেয়। সবকিছু ধ্বংস করে এমন উপায়ে, যে সেখানে মহা প্রলয়ের আভাস পাওয়া যায়। যেমনটি ঘটেছে ‘দ্য ফল অফ দ্য হাউজ অফ আশার’ গল্পে।
‘আশার বংশের পতন’ গল্পটি আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে এখান থেকে একটা গল্প লেখার আইডিয়া পেয়ে যাই। এই গল্পের মধ্যে যে রূপকের আশ্রয় তিনি নিয়েছেন তা এক কথায় অনবদ্য আর বিভীষিকাময়। গল্পটায় সামগ্রিকভাবে একটা প্রলয় দেখানো হয়েছে। যেখানে সবকিছুর শেষে রয়েছে শুধুই ধ্বংস। আশারের বন্ধুর এত এত প্রচেষ্টাও যে ধ্বংস আটকাতে পারে না। সুররিয়েলিস্টিক এই গল্পে কিছুটা হররের মিশ্রণ এর থিমটাকে একেবারেই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
‘লাল মড়ক’ গল্পে দেখা যায় মহামারীতে দেশ যখন মৃত্যুপুরী তখন দেশের রাজা-মন্ত্রীরা একটা দূর্গে সবকিছু থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে বিলাস ব্যসনে মত্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মৃত্যুকে কি তারা রুখতে পেরেছিলো? মুখোশধারী সেই রহস্যময় মানবমূর্তিটাই তো শেষ মেষ সব রক্ষাকবচ ভেঙে চির বাস্তব মৃত্যুর স্বাদ তাদেরকে দিয়েছিলো। এই গল্পে সাত রঙের সাতটি ঘরের যে মেটাফোর, তা ছিলো অভিনব আর বর্ণনাতেও ছিলো অদ্ভুত এক ভঙ্গি।
‘কালো বিড়াল’ গল্পটিতে আমরা দেখতে পাই মানব মনের পাশবিক দিকটাকে। কীভাবে একজন নম্র মনের মানুষ, যে কি না পশুপাখিকে এত ভালোবাসতো সেই এতোটা পাশবিক হয়ে পড়ে, যে অত্যাচারের চরমে পৌছে মেরে ফেলে তার অতি আদরের কালো বিড়ালটাকে। কিন্তু পাশবিকতা থাকায় কি মানুষ বল্গাহীন হতে পারে? উত্তরে গল্পের এন্ডিংটি একটা বার্তা দেয়। সবকিছুরই একটা প্রতিফল বা প্রতিদান আছে এটাই হয়তো লেখক বুঝাতে চাইছিলেন।
চোরাই চিঠি গল্পটিতে আমরা পরিচিত হবো সর্বপ্রথম গোয়েন্দা চরিত্র অগাস্ত দ্যুপোর সাথে। গল্পটাতে যুক্তিতর্কের যে ব্যাপারটি রয়েছে, যার মাধ্যমে মানব চরিত্রের বিভিন্ন ছোট ছোট আর সূক্ষ্ম দিক ধরা পড়ে। ব্যাপার হলো, গল্পটা নিছক থ্রিলার বা মিস্ট্রি না যেমনটি আজকাল হয়ে থাকে। পো-এর লেখার মধ্যেকার গভীর মর্ম আর মেটাফোরের ব্যাপারটি এখানেও পাওয়া যায়।
গল্পগুলোর গভীরতা, বার্তা আর পদ্ধতি বা আঙ্গিক সবকিছুই অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই কবে আন্তন চেখভের এক গুচ্ছ গল্প পড়ি। পো-এর গল্পগুলোকে আন্তন চেখভের ওই সব গল্পের সাথেই তুলনা দেওয়া চলে। তবে এর থেকে কে শ্রেষ্ঠ তা নিরূপণ করা চলে না। বইটা পড়ার পর থেকে পো-এর রচনার প্রতি আলাদা আগ্রহ তৈরি হতে বাধ্য। সেই আগ্রহ থেকেই তার অন্যান্য রচনা পড়ার একটা ইচ্ছা নিয়েই আজকের মতো শেষ করছি।
Leave a comment