আমরা সবাই চাই সুখী হতে। অনেকে বলেন যে সুখ বলতে কিছু ই নেই, সবই মরিচীকা। যদিও এটা সত্যি নয়। আমাদের সুখী হওয়ার মূল চাবিকাঠি কিন্তু রয়েছে আমাদের নিজেদের হাতেই। কারো কাছে আপনজন সুখ, কারো কাছে সাফল্য, আবার কারো কাছে অর্থ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ও কগনিটিভ বিভাগের একজন অধ্যাপক লরি স্যান্টোস বলেছেন, সুখী হতে হলে সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। ভালো সঙ্গীত শিল্পী বা ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠার মতোই সুখী হওয়ার ব্যাপারে চর্চা করতে হয়। জীবনে সুখী হতে কৃতজ্ঞ হতে শুরু করুন, পরিবারের সাথে আরও বেশি সময় কাটান, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করুন, দিনের একটা সময়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকুন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে সরে এসে আরও বেশি ঘুমাতে চেষ্টা করুন।
এখন চলুন আরও কিছু দিক সম্পর্কে আমরা জেনে নিই যেগুলো আমাদের সুখী হতে সাহায্য করবেঃ
**সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করুনঃ
সুখী হওয়ার অন্যতম ও প্রধান ধাপই হচ্ছে সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করা। এছাড়া আপনি দুশ্চিন্তা থেকে কখনোই মুক্তি পাবেন না। ভালো খারাপ সব মিলিয়ে আমাদের দিন যায়। খারাপ এর ভিতরেও ভালোটা খোঁজার চেষ্টা করুন। সকালে ঘুম থেকে একটা ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে উঠুন।
**নিয়মিত সঠিক পুষ্টিকর খাবার খানঃ
সুখী হওয়ার উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। শরীর স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে, ভালো কিছু উপার্জন করেও সুখী হতে পারবেন না। এজন্য স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন।
মদ ও ধুমপানে আসক্ত থাকলে তা পরিহার করুন। খাবার শরীর ও মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারে সেরোটোনিন উপাদান ‘ভালো লাগার ‘ হরমোন নিঃসৃত হয়। প্রোটিনে থাকা ডোপামিন মস্তিষ্কের সাথে দেহের সংযোগ স্থাপন করে। ডোপামিন হরমোন আনন্দ খুশিভাব উৎপন্ন করে। ভাজাপোড়া এবং অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার হতাশার একটি কারণ। সকালের নাস্তা রাজার মতো, দুপুরের খাবার প্রজার মতো আর রাতের খাবার ভিক্ষুকের মতো খেতে হবে।
**নিজেকে অন্যের সাথে আর তুলনা করবেন নাঃ
আজকে থেকেই নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করুন। কারও সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে নিজের মানসিক শক্তি কমে আসে। হতাশা কাজ করে। যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করুন। সবার প্রতিভা এক নয়। আর সবাই সব বিষয়ে প্রতিভাবান নয়। অন্যরা আপনার মতো নয় এবং আপনিও অন্যদের মতো নন। নিজের মধ্যে যা আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যান।
** দুশ্চিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তা আর নয়ঃ
দুশ্চিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তা কখনো সুখ ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। কোনো বিষয় যদি সুখ নষ্ট করে তাহলে সেই বিষয়ে ভাবনা- চিন্তা – কাজ ত্যাগ করাই শ্রেয়। অন্যকে ঘৃণা করে সময় নষ্ট করার জন্য জীবন খুব ছোটো, সকলকে ক্ষমা করে দিন সব কিছুর জন্য। অতীতকে নিয়ে শান্তভাবে চিন্তা করুন, ভুলগুলো শুধরে নিন। অতীতের জন্য বর্তমানকে নষ্ট করবেন না।
**সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ঘুমঃ
সুখী থাকার জন্য ঘুমটা খুবই জরুরি। প্রতিদিন চেষ্টা করুন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠার এবং ঘুমাতে যাওয়ার। ৮ ঘন্টার বেশি বা ৫ ঘন্টার কম ঘুমাবেন না। আমাদের সকল চিন্তা ভাবনা, কাজ ব্রেইন কে প্রভাবিত করে। এই ব্রেনকে এনার্জিটিক ও রিফ্রেশ রাখতে দরকার পর্যাপ্ত ঘুম। না হলে স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে। ভালো ঘুমের জন্য প্রয়োজনে গোসল করে নিন, বই পড়ুন বা এমন কিছু করুন যা আপনাকে মানসিকভাবে শান্তি দিবে।
রুমের পরিবেশ ঘুমের জন্য উপযুক্ত করে তুলুন। রুম অন্ধকার, ঠান্ডা, শান্ত রাখার চেষ্টা করুন।
**নিজের মতো সবাইকে ভালবাসুনঃ
নিজেকে তো অবশ্যই ভালোবাসতে হবে, সম্মান করতে হবে। এতে আপনার আত্নবিশ্বাস বাড়বে। আচ্ছা, আমরা কখনোই কী নিজের মতো অন্যদেরকেও ভালোবাসি, কয়জনই বা ভালোবাসি? যদি নিজের মতো করে সবাইকে ভালোবাসতেন তাহলে আর এতো সমস্যা আমাদের মাঝে থাকতো না। নিজের প্রতি অহংকার, অন্যের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ থাকতো না। যাদের মনে যত সমস্যা থাকবে, তারা ততো অসুখী হবে এটাই স্বাভাবিক। নিজের মতো অন্যদেরকে ভালোবাসার চোখে দেখলে একটা অন্যরকম শান্তি পাওয়া যায়।
**সবার সাথে ভালো ব্যবহার করুনঃ
আপনার একটুখানি ভালো ব্যবহারই অনেককে অনেক সুখী রাখতে পারে। সব ধরনের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকার এবং ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। জীবনে কে কোথায় কাজে লাগবে আপনি কিন্তু তা জানেন না। তাই সবার সাথে ভালো ব্যবহার করুন। কাউকে ছোটো ভাবা যাবে না। সবার সাথে ভালোভাবে থাকার চেষ্টা করুন।
**পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিনঃ
নিজের পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করুন। পরিবারের সদস্যদের সাথে সুন্দর অসাধারণ মুহূর্ত কাটান, ঘুরতে যান। একটা অন্য রকম সুখ শান্তি পাবেন যা আর কোথাও নেই।
**কৃতজ্ঞতার চর্চা করুনঃ
দিনশেষে যখন নীড়ে ফিরবেন, তখন চিন্তা করুন আপনি কতটা সফল। অনেকে আছেন, ঠিক আপনার জীবনটাই পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
প্রত্যেক রাতে যাদের কাছে বা যেসব জিনিসের কাছে কৃতজ্ঞ তার একটা তালিকা তৈরি করুন। যারা নিয়মিত এটার চর্চা করেন তারা বেশি সুখী অনুভব করেন। একটা পজিটিভ ভাইভ তৈরি হয়। সুখী থাকার বড়ো উপায় হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
**সহযোগিতা পূর্ণ মনোভাবঃ
অন্যকে উপকার করুন। সাহায্য করুন। বিপদে আপদে অন্যের পাশে দাঁড়ান। অন্যের সমস্যা গুলো শোনার চেষ্টা করুন। নিঃস্বার্থে অন্যকে সহায়তা করা আপনার মানসিক শান্তি বাড়িয়ে দিবে। এটি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী সুখী করে তুলবে। গরীবকে সাহায্য করুন। দাতা হোন, গ্রহীতা নন।
দেখবেন আপনার খারাপ সময়ে ও সবাই এগিয়ে আসবে।
**বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানঃ
পরিবারের পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে ভালো সময় কাটালে আপনি সুখী হবেন। অনলাইন এ সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুত্ব এর চেয়ে অফলাইনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বেশি করুন। যে সামনে আছে তাকে গুরুত্ব দিন।
**সমস্যার সমাধান খোঁজাঃ
সমস্যায় ডুবে না থেকে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার অভ্যাস মানুষকে সুখী করে। সমস্যার ভিতর এ হারিয়ে বা গিয়ে সেটা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে সমাধানের চেষ্টা করুন। এতে আপনি বেশ পজিটিভ হয়ে উঠবেন।
**কঠোর পরিশ্রমী হওয়ার চেষ্টা করুনঃ
পরিশ্রম ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন সম্ভব নয়। ভালো কিছু শিখতে হলে, জানতে হলে, অর্জন করতে হলে এবং নিজেকে উচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কঠোর পরিশ্রম ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যে যত বেশি কঠোর পরিশ্রমী সে তত বেশি সফল, আর যে সফল হবে সে সুখী থাকাটাই স্বাভাবিক। সঠিক, সৎ ও পজিটিভ পরিশ্রম জীবনে সুখ ও কল্যাণ বয়ে আনে।
**সাধারণ জীবনযাপনঃ
অনেক কিছু করার চাইতে অল্প কিছু অর্থপূর্ণ কাজ করা বেশি ভালো। বর্তমানে অনেক মানুষ এই কথাটি ভুলতে বসেছেন। নির্দিষ্ট একটা সময়ে যেকোনো একটা কাজ মনোযোগ দিয়ে করলে অর্থাৎ মাল্টি টাস্কিং না করলে মানুষ বেশি সুখী থাকে। আবার খুব বেশি বিলাসবহুল জীবন মানেই কিন্তু সুখী জীবন নয়। সবাই অসাধারণ জীবনযাপন এর স্বপ্ন দেখলেও সুখ ধরা দেয় সেই সাধারণ জীবনেই।
**স্বকীয়তা বজায় রাখুনঃ
কোনো মিথ্যে অভিনয় নয়, আপনি ঠিক যেমন তেমনই থাকুন। স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য যা ভালো লাগে তাই করুন। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অথবা অন্যদের চোখে ভালো সাজতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলা ঠিক নয়। অন্যরা কী ভাবলো সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
** নিজের সম্মান এবং আত্মমর্যাদা সবসময় ঠিক রাখুন।
** নিজের জন্য লক্ষ্য তৈরি করুন। প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটান। নিজের উপর আস্থা রাখুন আর আশাবাদী থাকুন।
সর্বোপরি, এভাবেই এই অভ্যাসগুলো চর্চার মাধ্যমে একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপনার সেই স্বপ্নের সুখী মানুষটা।।
লেখাঃ ঐশ্বর্য্য বিজয়া দাস
জুনিয়র কন্টেন্ট রাইটার,
রাইটার্স ক্লাব বিডি।।
Leave a comment