আই স রামাল্লা : মুরিদ বারঘুতি | I Saw Ramalla By Murid Barghuti

  • আই স রামাল্লা
  • লেখক : মুরিদ বারঘুতি
  • প্রকাশনী : নন্দন
  • বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার
  • অনুবাদক : মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ
  • পৃষ্ঠা : 176, কভার : পেপার ব্যাক
  • ভাষা : বাংলা

এই গোছানো, কিন্তু মারাত্মক রকমের ছন্দগত বর্ণনাটি বহুদিন নির্বাসিত থাকার পর জন্মভূমিতে ফিরে আসার প্রেক্ষিতে লেখা। ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতদের এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা আমরা বোধহয় আর পাইনি। বিখ্যাত কবি মুরিদ বারঘুতির লেখা। তিনি ষাটের দশকে বিয়ে করেছিলেন সর্বজনবিদিত মিশরিয় অ্যাকাডেমিক এবং ঔপন্যাসিক রাদওয়া আশোউর’কে। ষাটের দশকে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন তারা। বিয়ের পর স-তে-রো-টা বছর তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন! রাজনৈতিক যে কারণগুলো এই বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী তা আই স রামাল্লা’তে বর্ণিত হয়েছে; সেই সঙ্গে পশ্চিম তীর থেকে মুরিদের নির্বাসন এবং ত্রিশ বছর পর প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিস্থিতিও। ১৯৯৭ সালে বইটি প্রকাশিত হলে আরব বিশ্ব খুবই আগ্রহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে তা বরণ করে নেয়। সাহিত্যে নাগিব মাহফুজ পুরস্কার লাভ করে। আহদাফ সুয়েইফ বইটির দারুণ অনুবাদ করেন ইংরেজিতে, তিনি নিজে প্রখ্যাত মিশরিয় ঔপন্যাসিক এবং সমালোচক। তাই এটি এক অনন্য বই যেখানে দুই প্রতিভাবান একসাথে মলাটবদ্ধ হয়েছেন। এমন একটি কাজের ব্যাপারে কিছু কথা লিখতে পেরে আমি যারপরনাই আনন্দিত।
আমি নিজেও পঁয়তাল্লিশ বছর দেশ্যচ্যুত থাকার পর জেরুজালেমে একই রকমের একটা সফরে গিয়েছিলাম। এজন্য খুব ভালো করেই জানি অনুভূতির কোন মিশ্রণটা ভেতরে জন্ম নেয়—আনন্দ তো বটেই, সেই সঙ্গে আফসোস, দুঃখ, বিস্ময়, রাগ এবং আরো অনেক কিছু।

ফিলিস্তিন কোনো সাধারণ জায়গা নয়। ইতিহাস এবং একেশ্বরবাদের সব ধারায় জায়গাটি পরিচিত ছিল, কাছ থেকে দেখেছে সব ধরনের বিজেতা এবং সভ্যতাকে। ১৯৪৮ সালে দুঃখজনকভাবে বাস্তুচ্যুত করা স্থানীয় আরব অধিবাসী এবং ইউরোপ থেকে সদ্য আগত জায়োনিস্ট ইহুদিদের চলমান বিবাদের সাক্ষী এই দেশটি। ১৯৬৭ সালে অবশেষে পশ্চিম তীর আর গাজা দখল করে নেয় ইহুদিরা, যে দখলদারি আজও বলবৎ।
প্রত্যেক ফিলিস্তিনি আজ অদ্ভুত এক পরিস্থিতির শিকার। তারা জানে যে কোনো এককালে ফিলিস্তিন বলতে কিছু একটা ছিল। কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পায় নতুন একটা নাম, মানুষ আর পরিচিতিকে যারা ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি অস্বীকার করে! তাই ফিলিস্তিনে ‘ফিরে আসা’ খুবই অদ্ভুত….এমনকী ঝুঁকিপূর্ণ কাজও বলা যায়। বারঘুতির এই বইটি অস্তিত্ব পেয়েছে ইয়াসির আরাফাতের পিএলও এবং ইসরায়েলের মাঝে হওয়া ‘শান্তিচুক্তি’ (নামটি মারাত্মক রকমের ভুল)-এর কারণে। আমেরিকার মধ্যস্ততায় ১৯৯৩ সালে বাস্তবায়ন হওয়া এই চুক্তিটির কারণে কিছু ফিলিস্তিনি তাদের ঘরে ফিরতে পারে। আই স রামাল্লা বইটি শুরু হয় সীমান্ত এলাকার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বারঘুতি তখনই আবিষ্কার করেন—ইসরায়েলি সৈনিকরা তখনও পূর্ণ ক্ষমতায়।
প্রয়োজনের খাতিরেই বারঘুতির বইতে রাজনীতি এসেছে। লেখার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন যে ফিলিস্তিনে কোথায় থাকতে পারবেন এবং কোথায় পারবেন না, কোথায় যেতে পারবেন আর কোথায় পারবেন না, কতক্ষণ থাকতে পারবেন…. এবং যখন তিনি অনুপস্থিত থাকেন তখন সেখানে কী হয়।
ফ্রান্সে থাকা অবস্থায় তার ভাই মুনিফ দুঃখজনকভাবে মারা যান, একাকী। কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। সে করুণ উপাখ্যানও স্থান পেয়েছে বইটিতে। ঔপন্যাসিক ঘাসসান কানাফানি এবং কার্টুনিস্ট নাজি আল-‘আলির গুপ্তহত্যাও স্পর্শ করেছে বইটি। সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনিরা যতই প্রতিভাবান হোক না কেন, আচমকা মৃত্যু এবং অব্যাখ্যাত নিরুদ্দেশের আতঙ্ক সব সময় তাদের তাড়া করে। তাই আনন্দ আর আশার মাঝেও মাথা উঁচু করে বইটিতে দেখা দিয়েছে দুঃখ আর বিষাদ।

তবে বইটিকে ভিন্ন এক মাত্রা দান করে এর কাব্যিক লেখনশৈলী। বারঘুতি তার লেখায় ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে যেমন বিষ ঢালেননি, তেমনি আঙুল তোলেননি ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দের অদ্ভুত আচরণের জন্যও। ফিরে আসা এবং পুনর্মিলনীর ফাঁকে ফাঁকে বর্ণিত হারাবার দুঃখটা আমার কাছে আই স রামাল্লা’কে অনন্যতা দান করেছে। বইয়ের আনন্দঘন ও উল্লাসের বর্ণনার নিচে লুকিয়ে আছে নির্বাসনের দুঃখ; ফিরে আসার উদ্দীপনা নয়। বলতে গেলে এই ব্যাপারটাই বইটিকে একই সঙ্গে দুঃখের একটা মাত্রা আর পরিপক্কতার ছোঁয়া দান করেছে। আহদাফ সুয়েইফের অসাধারণ অনুবাদ এই দারুণ বর্ণনাশৈলীটিকে ইংরেজি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতাকে বইটি মানবিকতার নতুন মোড়কে উপস্থাপন করেছে।
-এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ
(সংক্ষেপিত)

এক সেই সেতুটি

সেতুর ওপর মারাত্মক গরম। কপাল থেকে একফোঁটা স্বেদবিন্দু গড়িয়ে প্রথমে আমার চশমার ফ্রেম তারপর লেন্সের ওপর এসে পড়ল। যা দেখছি, যা আশা করছি….যা স্মৃতিতে ভেসে উঠছে—সবই ঘিরে রেখেছে কুয়াশা। চোখের সামনে যেন ঝিকঝিক করছে একটা জীবনের সব স্মৃতি; এমন এক জীবনের স্মৃতি, যেটা কেটে গেছে এখানে পৌঁছুবার চেষ্টা করে করে! অবশেষে সফল হয়েছি, পেরোচ্ছি জর্ডান নদী। পায়ের তলে পড়ে কাঠ ফাটার আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। বাঁ কাঁধে ঝুলছে একটা ছোট্ট ব্যাগ। স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছি পশ্চিম পানে—অথবা বলা যায়, এমনভাবে হাঁটছি যা দেখে সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। পেছনে পড়ে রয়েছে দুনিয়া। আর সামনে? আমার দুনিয়া!
এই সেতুর ব্যাপারে আমার শেষ স্মৃতি হলো: তিরিশ বছর আগে রামাল্লা থেকে আম্মানে যাবার পথে সেতুটি পেরোনো। আম্মান থেকে গিয়েছিলাম কায়রোতে, আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তখন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ, মানে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম আমি।
১৯৬৭ সালের ৫ জুনের সকাল: ল্যাটিন-পরীক্ষা ছিল। অল্প কয়েকটা পরীক্ষাই বাকি আছে: ল্যাটিন, দুই দিন পর ‘উপন্যাস’, তারপর ‘ড্রামা’। তাহলেই মুনিফের কাছে কৃত ওয়াদা পালন হবে। পূর্ণ হবে মায়ের তার একটা ছেলেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করতে দেখার স্বপ্নও। আগের পরীক্ষাগুলো— ইউরোপিয়ান সভ্যতার ইতিহাস, কবিতা, সাহিত্য-সমালোচনা এবং অনুবাদ— ভালো মতোই শেষ হয়েছে। পথের আর বেশি বাকি নেই। ফলাফল প্রকাশিত হলেই আমি ফিরে যাব আম্মানে। সেখান থেকে—এই একই সেতু পেরিয়ে— পা রাখব রামাল্লায়; বাবা-মায়ের চিঠি থেকে জানতে পেরেছি: আল-লিফতালি দালানে আমাদের যে বাড়িটা আছে সেটা সাজানো হচ্ছে, সনদ নিয়ে আমার ফেরার আনন্দে!
পরীক্ষা কক্ষে মারাত্মক গরম পড়েছে। একটা স্বেদবিন্দু আমার ভ্রু গড়িয়ে স্পর্শ করল চশমার ফ্রেমটাকে। একটু থমকে আবার গড়াতে লাগল কাচের ওপর দিয়ে। তারপর টুপ করে ঝড়ে পড়ল পরীক্ষার খাতায় লেখা ল্যাটিন শব্দগুলোর ওপর: আলটাস, আলটা, আলটাম—কিন্তু বাইরে আওয়াজ কীসের? বোমা বিস্ফোরণ? মিশরীয় সেনাবাহিনীর মহড়া? বিগত কিছুদিন হলো যুদ্ধের কথা বাতাসে উড়ছে। অবশেষে শুরু হয়ে গেল? এক টুকরো টিস্যু দিয়ে আমার চশমা মুছে নিলাম, দেখে নিলাম প্রশ্নের উত্তরে কী লিখেছি। তারপর আসন ছেড়ে খাতা তুলে দিলাম পরিদর্শকের হাতে। ছাদের হলদে পলেস্তরার শুকিয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট টুকরো টেবিলে রাখা খাতার ওপর পড়ল। বিরক্তির সঙ্গে ছাদের দিকে তাকালেন পরিদর্শক, আমি বেরিয়ে এলাম।
আর্টস ফ্যাকাল্টির সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম আমি। মাদাম আইশা— আমার মাঝবয়সি সহপাঠিনী, স্বামীর মৃত্যুর পর আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে—বসে আছেন তার গাড়িতে, ক্যাম্পাসের খেজুর গাছটার নিচে। ফরাসি টানে ডাকলেন আমাকে, খানিকটা দুশ্চিন্তা টের পেলাম তার কণ্ঠে, “মুরিদ! মুরিদ! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা তেইশটা প্লেন মাটিতে ফেলেছি!”
গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম, দরজা ধরে আছি। আহমাদ সাইদের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে আসছে গাড়ির রেডিয়ো থেকে। জোরে জোরে বাজতে শুরু করে দেশপ্রেম মাখা গানগুলো। ছাত্রদের একটা দঙ্গল আমাদেরকে ঘিরে ধরল। চারপাশ থেকে মন্তব্য ছুটে আসছে—কিছু প্রত্যয়ী তো কিছু সন্দেহমাখা । পরীক্ষার সময় পেলিক্যান কালির যে বোতলটা সবসময় সঙ্গে রাখি, শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম সেটাকে। আজও জানি না কেন, বাতাসে লম্বা একটা বৃত্তচাপ এঁকে আমার হাতটা সর্বশক্তিতে ওই খেজুর গাছের গায়ে মিডনাইট ব্লু-রঙা কালির বোতলটাকে ছুঁড়ে মেরেছিল! আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোতলটা শত টুকরো হয়ে আশ্রয় নিলো প্রাঙ্গণে।
ওখানেই শুনতে পেয়েছিলাম, ভয়েস অভ দ্য অ্যারাবস রেডিয়ো স্টেশন থেকে আহমাদ সাইদের কণ্ঠ আমাকে জানিয়েছিল: রামাল্লা আর আমার নেই, আর আমি ফিরতে পারব না ওখানে।
শহরটা শত্রুর হস্তগত হয়েছে! চার হপ্তার জন্য পরীক্ষা স্থগিত হলো। তারপর আবার শুরু হলে আমি পাশ করলাম। ডিপার্টমেন্ট অভ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার থেকে আমাকে বিএ ডিগ্রি দেওয়া হলো। কিন্তু সেই সনদটা ঝোলাবার মতো দেয়াল যে আমার আর রইল না!
যুদ্ধ শুরু হবার সময় যারা দেশের বাইরে ছিলেন, তারা সম্ভাব্য সব উপায়ে দেশে ঢোকার অনুমতিপত্র লাভের প্রয়াস চালালেন। ফিলিস্তিনে থাকা তাদের আত্মীয়দের সাহায্য তো নিলেনই, সেই সঙ্গে রেড ক্রসের দ্বারস্থ হতেও ছাড়লেন না। কেউ কেউ আমার ভাই মাজিদের মতো বেআইনি পথে ঝুঁকি নিয়ে ঢুকলেন দেশে!
শত শত বয়স্ক মানুষকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেও, ইসরায়েল হাজারো যুবক-যুবতীকে আটকে দিল। আমাদের জন্য বরাদ্দ হলো নতুন একটা নাম—নাজিহিন, বাস্তুচ্যুত।
বাস্তুহারা হওয়া মরণের সমান। মানুষ ভাবে—ওসব শুধু অন্যের সঙ্গেই হয়। ৬৭ সালের সেই গ্রীষ্মে আমি এমন শ্রেণিতে নাম লেখালাম, যা কেবল অন্যদের সঙ্গে হয় বলেই ভাবতাম!
যে মানুষটা তার বসবাসের অনুমতিপত্র নবায়ন করতে যায়, সে যেন একেবারে অচেনা এক ব্যক্তি! নানা ফর্ম পূরণ করতে হয় তাকে, কিনতে হয় ডাকটিকেট। পদে পদে তাকে সাক্ষ্য-প্রমাণের ব্যবস্থা করতে হয়। সবাই তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কোত্থেকে এসেছো, ভাই?’ অথবা জানতে চায়, ‘তোমার দেশে গ্রীষ্মে গরম কেমন পড়ে?”
যে দেশে সে বাস করে, সেখানকার নাগরিকদের দুশ্চিন্তা তার দুশ্চিন্তা নয়, আবার সেই দেশের ‘স্বরাষ্ট্র নীতিমালা’ নিয়েও সে মাথা ঘামায় না। অথচ এসবের প্রভাব সর্বপ্রথম ভোগ করতে হয় তাকেই। সেই নাগরিকদের আনন্দের ক্ষণে তাদের সঙ্গে যোগ না দিতে পারলেও, তাদের ভয়ের মুহূর্তগুলো স্পর্শ করে তাকেও। সব ধরনের অনুষ্ঠানে তাকে দেখানো হয় ‘বহিরাগত’ হিসেবে, সে এমন একজন, যার সঙ্গে প্রত্যেকটা স্থানের সম্পর্ক অদ্ভুত রকমের বিকৃত। সেগুলোর প্রতি একই সঙ্গে আকৃষ্ট আর বিকর্ষিত হয় বেচারা। এই বাস্তুহারারা এমন একজন, যে একনাগাড়ে নিজের গল্প শুনিয়ে যেতে পারে না, যাকে প্রতিটা মুহূর্তে এক-একটা ঘণ্টা কাটাতে হয়! তার সামনে প্রতিটা লহমা উপস্থিত হয় অনন্তের ব্যাপ্তি নিয়ে। তার স্মৃতিগুলো বদলাতে চায় না। নিজের ভেতরের সুনির্দিষ্ট এক গোপন, নীরব স্থানে বাস করে সে।
গোপনীয়তাকে সাবধানে আগলে রাখে, কেউ নাক গলাতে চাইলে তা সহ্য করে না। এমন এক জীবনকে আঁকড়ে ধরে যাপন করতে চায়, যার প্রতি আশপাশে থাকা মানুষদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই! কথা বলার সময় স্বপ্নের জীবনের উপাদানগুলো ঘোষণা করতে পারে না, বরং অস্ফুট কণ্ঠে কেবল উচ্চারণ করে। টেলিফোনের ঝনঝনানি ভালোবাসে সেই বাস্তুহারা, আবার একই সঙ্গে ভয়ও পায়। এই অচেনা, অজানা লোকটাকে দয়ালু মানুষরা বলে, ‘এটাকে তোমার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে কল্পনা করো, ধরে নাও যে আপনজনের মাঝেই আছো।’ অচেনা হবার কারণে তাকে ঘৃণা করা হয়, অথবা হয়তো সে কারণেই করুণা পায়। সত্যি বলতে কী, করুণাকে সহ্য করা, ঘৃণাকে বরণ করে নেওয়ার চাইতে কঠিন!
সেই সোমবার দুপুরে আমাকেও যেন টেনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো বাস্তুহারাদের কাতারে।
আমার মতো ‘অচেনা’ অনেকে যে তাদের নিজেদের দেশেই বাস্তুহারা হয়ে আছে, তা বোঝার মতো পরিপক্বতা কি তখন আমার ছিল? এমন অনেক দেশ বিদেশি শক্তি দখল করে আছে। আবু হাইয়ান আল-তাওহিদি’ কি ভবিষ্যতের ওপর নজর রেখেই বহুকাল আগে লিখেছিলেন যে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে আমাদের এই হাল হবে? প্রথম ভাগের চাইতে কি দ্বিতীয় ভাগটা লম্বা? জানি না।
তবে এতটুকু জানি যে সেই অচেনা লোকটি কখনো আর তার আগের সত্তায় ফিরতে পারবে না। যদি ফেরেও, আবিষ্কার করবে সব শেষ হয়ে গেছে। মানুষ যেমন হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়, তেমনই আক্রান্ত হয় ‘বাস্তুচ্যুতিতেও’; দুই রোগের একটারও নিরাময় নেই। কবিদের অবস্থা তো হয় আরো খারাপ, কেননা কাব্য যে নিজেই বাস্তুচ্যুত! এসবের সঙ্গে হাঁপানির কী সম্পর্ক? জর্ডান নদীর তীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘অপরপক্ষ’র (ফিলিস্তিনি পুলিস ইসরায়েলিদের এই নামেই ডাকে) অপেক্ষা করতে করতে যে কাশির দমক হয়েছিল, সেটাই কি এর কারণ?
সেতুর এপাশে, মানে জর্ডানের তীরে এসেছি আম্মান থেকে। আমার ভাই ‘আলা গাড়ি চালিয়ে এনেছে। ওর স্ত্রী এলহাম আর আমার মাও আছেন সঙ্গে। সকাল সোয়া নয়টায় আমরা শ্মাইসানি’র বাড়িটা থেকে বেরিয়ে দশটার আগেই পৌঁছে যাই এখানে।
সেতুর ঠিক শেষ মাথায় থাকা অপেক্ষা-কক্ষে বসে রইলাম, জর্ডানিয়ান অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম পরের ধাপ সম্পর্কে। ‘ওদের তরফ থেকে সিগন্যাল পাবার আগপর্যন্ত আপনাকে এখানে বসে
১. একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ইরাকি দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী ও সুফি লেখক থাকতে হবে, তারপর আপনি সেতু পেরোতে পারবেন।’
বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম কামরায়, বুঝতে পারলাম যে অপেক্ষার প্রহর আরো দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে চেয়ে রইলাম নদীর দিকে।
ওটার ক্ষীণ প্রশস্ততা আমাকে অবাক করল না: জর্ডান নদী বরাবরই সরু ছিল। আমরা সেই ছেলেবেলা থেকে এমনটাই দেখে আসছি। বিস্মিত হলাম এতগুলো বছর পর ওটাকে পানিশূন্য নদীর রূপে দেখে…পুরো না, প্রায় পানিশূন্য। ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রকৃতি যেন ওটা থেকে পানি শুষে নিয়েছে। আগে একটা কণ্ঠ ছিল নদীটির, সেটাকে যেন গলা টিপে নষ্ট করা হয়েছে; নীরব নদীতে পরিণত হয়েছে সে; পার্ক করা গাড়ির মতো নীরব!
অন্য পাশের দৃশ্যটা খালি চোখেই দেখা যায়। আর চোখ যা দেখতে চায়, কেবল সেটাই দেখে। যে বন্ধুরা অনেক দিন পর নদীটা পার হয়েছে তারা জানিয়েছে—এখানে আসার পর প্রত্যেকে কেঁদে ফেলেছিল। তবে আমার চোখ শুকনো।
বুকের হালকা অবসন্নতা ওপরে উঠে চোখজোড়াকে স্পর্শ করতে পারল না। অপেক্ষার ওই প্রহরগুলোতে আমার চেহারা কেমন হয়েছিল, তা বলার জন্যও সঙ্গে ছিল না কেউ।
সেতুটার দিকে তাকালাম আমি। পেরোতে পারব তো? নাকি শেষ মুহূর্তে কোনো সমস্যা হবে? আমাকে ফিরিয়ে দেবে ওরা? কাগজপত্র কিংবা পদ্ধতিতে কোনো ফাঁক আবিষ্কার করবে? সত্যি সত্যি পা রাখতে পারব ওপাশে? ওই পাহাড়গুলোতে, যেগুলো আমার সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে?
জর্ডানের যে পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি তার সঙ্গে সেতুর ওপাশের ফিলিস্তিনি জমির কোনো ভূতাত্ত্বিক পার্থক্য নেই।
তবে হ্যাঁ, ওই জায়গাটা ‘দখলকৃত’!
১৯৭৯ সালের শেষের দিকে আমি দামেস্কে একটা কনফারেন্সে ছিলাম, দ্য ইউনিয়ন অভ অ্যারাব রাইটার্স কর্তৃক আয়োজিত ছিল ওটা। আমাদের আমন্ত্রণকারী নিয়ে গেছিলেন কুনাইতেরাহ শহরে। সংক্ষিপ্ত পথটা অতিক্রম করেছিলাম গাড়ি বহর সঙ্গে নিয়ে, ইসরায়েলিরা ওই শহরের কী হাল করেছে তা নিজ চোখে দেখেছি! কাঁটাতারের এপাশে ছিলাম আমরা, ওপাশে পতপত করে উড়ছিল ইসরায়েলের পতাকা। হাত বাড়িয়ে বেড়ার ওপাশ থেকে তুলে নিয়েছিলাম বুনো প্রকৃতিতে বেড়ে উঠতে থাকা কিছু গুল্ম। ওটাকে নাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হুসেইন মুরুওয়াকে বলেছিলাম, ‘এই যে দেখো, দখলকৃত স্থান, 

ফিলিস্তিনি কবি ও লেখক মুরিদ বারঘুতি ১৯৬৬ সালে কায়রোতে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। এর এক বছর পরই ফিলিস্তিন দখল করে নেয় ইসরায়েল; প্রবাসে থাকা সমস্ত ফিলিস্তিনির প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এক লহমায় বদলে যায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মতো মুরিদ বারঘুতির জীবনও। সব থাকার পরও হয়ে যান এক উদ্বাস্তু, শরণার্থী। কিন্তু দেশে ফেরার আকুলতা কখনও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। নানান ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ত্রিশ বছর পর তিনি কিছুদিনের জন্য অনুমতি পান তাঁর শহর রামাল্লায় ফেরার।

ত্রিশ বছর পরে মাতৃভূমিতে ফেরার পর কী দেখলেন তিনি? কতখানি বদলে গেছে চিরচেনা সেই গ্রাম কিংবা মানুষগুলো? কীভাবেই বা কেটেছে গত ত্রিশ বছর—রামাল্লায় ফেরার চেষ্টা করে করে?

এখানে লেখক আমাদের শুধু চিরচেনা যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনকেই নয় বরং পরিচয় করিয়ে দেন এক অচেনা ফিলিস্তিনের সাথে। যেই ফিলিস্তিনে আছে প্রেম, রাজনীতি, ইন্তিফাদা, কবিতা, ট্রাজেডি এবং কমেডি!

লেখকের সাথে সাথে আপনিও পৌঁছে যাবেন ফিলিস্তিনের এক ছোট্ট গ্রাম দাইর ঘাস্‌সানাহ’তে। লেখকের চোখে জীবন্ত হয়ে উঠবে রামাল্লা। শেষ পাতাটি পড়ে ফেলার পর হয়তো আপনিও বলে উঠবেন—আই স রামাল্লা!

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?