খেলা আসক্তি

খেলাধুলা বা স্পোর্টস বিষয়টা নতুন কিছু নয়। সেই আদিকাল থেকেই মানুষ ছুটোছুটিপ্রিয়। সেই ছুটোছুটিকেই কিছু নিয়ম-কানুনের জালে আটকে ফেলে শুরু হয় খেলার। ঠিক কবে থেকে খেলাধুলা শুরু হয়েছে, তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলেও, বর্তমান বিশ্বে খেলাধুলা একটি সুবিশাল অংশ দখল করে আছে সন্দেহ নেই।

মানুষ খেলাধুলা কেন করে, সেই প্রশ্নের অনেক রকম উত্তর হয়। কেউ ফুরফুরে সময় কাটাতে খেলেন, কেউ সময় ‘কিল’ করতে খেলেন, কেউ শরীর ফিট রাখতে খেলেন, কেউ পয়সা কামাতে খেলেন। তবে এতগুলো উদ্দেশ্যের মাঝে খেলাধুলা করার সবচে মোক্ষম উদ্দেশ্য হতে পারে শরীর ফিট রাখা। সন্দেহাতীতভাবেই খেলাধুলা ফিটনেস ধরে রাখার ও শরীরকে সুস্থ-সবল রাখার একটি কার্যকর মাধ্যম।

তবে বিংশ শতাব্দীর এই সময়টাতে, খেলাধুলা আদৌ আর কেবল শরীরচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেঁচে আছে কিনা, তা নতুন করে ভাবনার প্রয়াস রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখনকার সময়ে খেলাধুলা ‘করার’ চাইতে ‘দেখার’ বিষয় হয়েছে বেশি।

খেলাপ্রেমী জাতি হিসেবে মার্কিনিদের বেশ নামডাক রয়েছে। বিচিত্র কিসিমের নানারকম খেলাধুলায় তাদের সরব উপস্থিতি। তবে অনলাইন বিভিন্ন ব্লগ ও এনালিসিস থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই মার্কিনিদের মাঝে এখন খেলাধুলা হয়েছে ড্রইংরুমের টিভি সেটের ভেতরে চেপে রেখে তাতে ফ্যানাটিক হয়ে যাওয়ার বিষয়। যে কেউ চাইলে গুগলে স্পোর্টস এডিকশান সার্চ দিলে অনেক তথ্য মিলবে, যাতে স্পোর্টস এর প্রতি (দেখার প্রতি, খেলার প্রতি নয়) অতিমাত্রায় তাদের এই আকর্ষণকে রীতিমতো ‘নন-মেডিক্যাল পদ্ধতিতে’ এডিকশান বা আসক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

শুধু মার্কিনিদের দিকে চেয়ে লাভ নেই। আমরা খোদ বাঙালিরাই এই ধরনের আসক্তিতে পতিত। দুর্মুখেরা বলে, বাঙালি আরামপ্রিয় জাতি। কথাটা কতটা সত্য, সেদিকে না গিয়ে বর্তমান খেলাধুলার প্রেক্ষাপটে নজর দিলে দেখা যাবে, আমরা যতটা না খেলি, তার চাইতে বহুগুণ বেশি খেলা নিয়ে মাতামাতিতেই পড়ে থাকি। সেটা বাংলার দামাল ছেলেদের কামাল খেলা নিয়ে হই-হুল্লোড় হোক কিংবা ইংলিশ প্রিমিয়ার/লা লিগা নিয়ে রাতভর চেঁচামেচিই হোক।

অনেক বিশ্লেষক যখন আসক্তির বিশ্লেষণ করেন, তখন আসক্তির কয়েকটি মাত্রা নির্ধারণ করেন। কী ধরনের আচরণ কোনো একটি বিষয়ের প্রতি কাউকে আসক্ত করে তুলতে পারে বা কী কারণে তাকে সে বিষয়ে আসক্ত বলা যায়, সে বিষয়ে তারা আলোকপাত করেন। মেডিক্যাল সায়েন্স যদিও এখন পর্যন্ত ‘খেলা দর্শনে আসক্তি’ নামে অফিশিয়ালি কোনো এডিকশানের ঘোষণা দেয়নি, তারপরেও অন্যান্য আসক্তির সাথে কিছু মৌলিক মিল পাওয়া যায় খেলাধুলার প্রতি অতি মনোযোগের মাঝে।

বাস্তবে এই খেলাধুলার প্রতি অতিমাত্রায় জড়িয়ে যাওয়া আমাদের সময়কে কীভাবে ধ্বংস করছে, তা হয়তো আমরা অল্পই উপলব্ধি করছি। এর পেছনে মুখ্য ভূমিকায় আছে টিভি সেট কিংবা হালের স্মার্টফোন। যেটির অনুপস্থিতিতে অনেকেই হয়তো সময়গুলো অন্য কোনো উত্তম খাতে ব্যয় করতে সক্ষম হতাম।

জার্মানির আলোচিত সমালোচিত হিটলারের নামে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তবে এটা জাপানের নামেও প্রচলিত আছে। গল্পটা নেহায়াতই হয়তো জোক। তবে মেসেজটা গুরুত্বপূর্ণ।

জার্মানিতে ক্রিকেট খেলা এসেছে তখন। তিনি খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খেলা চলছে?’ সে ব্যক্তি উত্তর দিল ‘ক্রিকেট।’ হিটলার কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। দুই তিন দিন পর আবার হিটলার সেই খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনও খেলা চলছিল। খেলা শেষে হিটলার একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কত নাম্বার খেলা চলছিল?’ সে ব্যক্তি উত্তর দিল, ‘ওইদিনের খেলাটাই।’ হিটলার অবাক হয়ে বললেন, ‘জিতল কে?’ ব্যক্তি উত্তর দিল, ‘কেউ না, খেলা ড্র।’
এরপর হিটলার জার্মানিতে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করে দিলেন।

বই : চয়ন
লেখক : ড. মানজুরে ইলাহী, আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক

Leave a Reply 31

Your email address will not be published. Required fields are marked *