জীবনটা সুন্দর হোক উদারতার রঙে – লেখক : শাইখ আলী জাবির আল ফাইফী | Jibonta Sundor Hok Udarotar Ronge

  • জীবনটা সুন্দর হোক উদারতার রঙে
  • লেখক : শাইখ আলী জাবির আল ফাইফী
  • প্রকাশনী : রুহামা পাবলিকেশন
  • বিষয় : ইসলামী সাহিত্য
  • অনুবাদক : হাসান মাসরুর
  • পৃষ্ঠা : 180, কভার : পেপার ব্যাক
  • ভাষা : বাংলা
এখানে এমন কিছু প্রবন্ধ আছে, যেগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে কাছাকাছি সময়ে লিখেছি। প্রবন্ধগুলোর একটির সাথে অপরটির সূক্ষ্ম মিল রয়েছে। একটি অপরটির পরিপূরক বলা চলে। এগুলোর প্রকৃতি একই রকম। আর এ কারণে এলোমেলো আর অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে থাকা এসব প্রবন্ধকে সুন্দরভাবে একত্রিত করে একটি বই আকারে পাঠকের সামনে নিয়ে আসতে উৎসাহ পাই।
জীবনপরিক্রমায় আমার সাথে বা আমার পরিচিত কারও সাথে ঘটিত কিছু কথা এখানে তুলে এনে সেসব কথাকে নিজের বহু বছরের অভিজ্ঞতার মিশেলে এরপর সেই সাথে কুরআনের আয়াত বা হাদিসের কথা বা প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী দিয়ে কিংবা কবির সারগর্ভ পঙ্ক্তিতে অথবা ভগ্ন হৃদয়ের আকুতি বা উজ্জ্বল মুচকি হাসিতে সাজিয়ে তুলে ধরেছি।
এরপর এগুলোকে এমনভাবে সুবিন্যস্ত করেছি, যাতে তা সবার জন্য সহজ ও বোধগম্য হয়, প্রাথমিক পর্যায়ের কারও জন্যও যেন তা বুঝতে অসুবিধা না হয়।
এ বইতে আমি মা ও তার নরম হৃদয়ের কথা বলেছি; বাবা ও তার উষ্ণ ভালোবাসার কথা এনেছি; এনেছি শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি তার সদয় আচরণের কথা; এনেছি ভাই-ভাইয়ের মধ্যকার ভালোবাসা, স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা; আরও এনেছি সে বন্ধুর কথা, যার অস্তিত্বের কারণে জীবন হয় সুন্দর ও সুখময়।
এখানে যেমন বিবিধ মহৎ কথা তুলে ধরেছি, তেমনই উল্লেখ করেছি আমাদের আশপাশে বিরাজমান বিভিন্ন মন্দাচারের কথাও। বলেছি উদারতার কথা। মানুষের হৃদয়কে ভরিয়ে দেওয়া কল্যাণের কথা। বলেছি কিছু অন্তরের রোগের কথা। বলেছি তার নিরাময়ের কথাও।
এ বইতে আমি আশ্চর্য সব কল্পকাহিনি বা অদ্ভুত গালগল্প আনিনি, কিংবা আনিনি কিংবদন্তির আখ্যান; বরং চেষ্টা করেছি সেসব দৃশ্য নিয়ে কথা বলতে, যা আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে, প্রতিনিয়ত আমরা যেসব কিছুর সম্মুখীন হই । আমি বরং ঘটিত-ঘটমান সেসব দৃশ্যকে একটি বিশেষ চশমায় অবলোকনের চেষ্টা করেছি—যে চশমার রং ভিন্ন; যা আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার রঙে রঙিন।
কোনো প্রসিদ্ধ বা জ্ঞাত বিষয় উল্লেখ করে তাকে একটা কাঠামোতে নিয়ে এসে কিছু উদাহরণ দিয়েছি বা আরও স্পষ্ট করে সেটাকে আলোকপাত করেছি। ঘটনার ভেতরে দেখার চেষ্টা করেছি, সেসব তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।
(প্রিয় পাঠক) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আপনাকে এ বইতে আপনার প্রত্যাশিত বিষয়টি পাইয়ে দেন— যদি তা নাও হয়, তবে ক্ষমা করবেন, দুআয় স্মরণ রাখবেন। আল্লাহ আমাকে আপনাকে ক্ষমা করে দিন।…
আলী জাবির আল-ফাইফি ০৯/০৪/১৪৩৮ হিজরি।
পণ
আমার অন্তরে বুনে আছে আপনার স্বপ্ন,
আমার সামনে উজ্জ্বল হয়ে আছে আপনার অবদান।
মা আমার, আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, সব সময় বিশ্বস্ত থাকব। আপনার সকল মায়া-মমতা ও ভালোবাসার দাবি পূরণ করব। আপনার বলা সেসব গল্প আমার আশার আলো, যা আমার জীবনবাগানকে করেছে গোলাপের ন্যায় সুন্দর-সুশোভিত। রাতের বেলায় আপনার সেসব দুআ আমার রক্ষাকবচ, সেসব দুআর ফসল এখনো আমি পাই। আমার মা, জীবনের প্রথমবার আপনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার সে উষ্ণ মমতা এখনো আমি অনুভব করি। এখনো সেসব ভালোবাসা অনুভূতিতে বিরাজ করে, যেন কোনো সঞ্জীবনী এখনো শক্তি দেয় আমায়….

আমার মায়ের কাঁকন

আমার মায়ের এত বেশি সম্পদ ছিল না যে, তা দিয়ে তিনি আমার সব আবদার মেটাবেন! কিন্তু তার অনেক বড় একটি হৃদয় ছিল। তিনি আমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও আমাকেই নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নিলেন আর আমাকে গড়ার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন।…
আপনি যদি ধনী হন, তাহলে ইচ্ছে করলে কাউকে অনেক বড় জিনিস দিতে পারেন, বড় বড় উপহার দিতে পারেন, বড় অঙ্কের সদাকা করতে পারেন। কিন্তু অবস্থা ঠিক উলটো হয়ে যাবে, যদি আপনি দরিদ্র হন। তখন আপনি চাইলেও বড় কিছু কাউকে দিতে পারবেন না, কাউকে বড় বড় উপহার দেওয়াও সম্ভব হবে না। তখন আপনি অন্যের জন্য কিছু করতে চাইলেও ছোট ও সামান্য কিছু করতে পারবেন। ছোট ও সামান্য উপহার অবশ্য তেমন মর্যাদা পায় না, যেমন পায় বড় আকারের কোনো উপহার।
কিন্তু আপনার ছোট ছোট উপহারের সাথে যদি কিছু জিনিস যুক্ত করে দেন,
তাহলে সে ছোট উপহারও বড় ও মহান হয়ে উঠবে!
হ্যাঁ সত্যি বলছি!
জানতে চান, সে জিনিসটা কী?
মনুষ্য সুঘ্রাণ
১৪০৪ হিজরি। আমি তখন তাবুক শহরের একটি মাদরাসার প্রাথমিকের ছাত্র। এতিম, দরিদ্র এক ছেলে। আমার বাবা নেই যে, অন্য শিশুরা বাবার কাছে যেমন আবদার করে তেমন আবদার করব! অতিবাহিত সে দিনগুলোতে আমার এমন বাবা ছিল না যে, শৈশবে আমি যার কোলে মাথা গুঁজিয়ে সুখ নেব।
ওদিকে আমি তখন ‘হাইদি’ কার্টুন সিরিজ দেখছি আর ঠান্ডা চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খাচ্ছি। তখন আমার মনে বাবার এমন একটি চিত্র আঁকা ছিল, যা ছিল কষ্ট আর বিক্ষিপ্ত চিন্তায় ভরা। কেবল এতটুকুই যে, কষ্ট আর উদ্বেগের বাইরে কিছুই খুঁজে পেতাম না আমি।
এদিকে আমার মায়ের এত বেশি সম্পদ ছিল না যে, তা দিয়ে তিনি আমার সব আবদার মেটাবেন! কিন্তু তার অনেক বড় একটি হৃদয় ছিল। তিনি আমার সব স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও আমাকেই নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নিলেন আর আমাকে গড়ার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন।
আমার ক্লাসের এক ছাত্র ‘আব্দুল্লাহ কাসিম’। একদিন দেখলাম, সে ব্যাগ থেকে
স্যান্ডউইচ বের করছে, যার ভেতর আশ্চর্য কালো রঙের কী যেন লাগানো।
তার কয়েক দিক থেকে যেন মাখামাখা তেল গড়িয়ে পড়ছে।
দেখেই মনে হলো, বেশ সুস্বাদু হবে। তখন আমি মলিনমুখে কষ্টভরা নয়নে সেদিকে তাকাতে লাগলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, না জানি খাবারটা কত মজার! মনে হয়, আমার সে সহপাঠী আমার চোখে এক এতিমের চাহনি দেখতে পায়, যে বড়ই শীর্ণকায় আর যুদ্ধ করছে কঠিন দুই সৈন্যদলের বিরুদ্ধে—এক. তীব্র ক্ষুধার সৈন্যদল । দুই. প্রবল লোভের সৈন্যদল।
আমার সেই সহপাঠী আমাকে তার স্যান্ডউইচটি ভাগ করে দিল। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, সে তো কেবল একটি স্যান্ডউইচ নয়; বরং তার সম্পদকে দুই ভাগ করে এক ভাগ আমাকে দিল। আমাকে তার সাম্রাজ্যের অর্ধেক দিয়ে দিল। মুতানাব্বির কাছে কাফুর ইখশিদি যতটা সম্মানিত ছিল, সে আমার চোখে তার চেয়েও বেশি সম্মানিত হয়ে গেল। আমি সে অর্ধেকটা খেলাম। এমন স্যান্ডউইচ খেয়ে আমি কতটা মুগ্ধ হলাম, তা তাকে জানালাম।…
পরের দিন আমি সব ভুলে গেলাম। আমি তখন জানতামও না যে, এমন কিছু আসলেই ভুলে যাওয়া উচিত কি উচিত নয়। কিন্তু আরেকজন কিন্তু ভুলেনি। আরেকটা অন্তর এক এতিমের কথা মনে রেখেছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম আব্দুল্লাহ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এরপর সে তার ব্যাগ থেকে দুটি স্যান্ডউইচ বের করল! আমি তার দিকে চেয়ে থাকলাম। তখন সে আমাকে বলল, তার মা আজ দুটো বানিয়ে দিয়েছে। একটা তার জন্য, আরেকটা আমার জন্য! আমি তখন বেশ আনন্দ অনুভব করলাম। অনুভব করলাম আমাকে ভালোবেসে জড়িয়ে নিয়েছে কেউ।….
আব্দুল্লাহর মা হয়তো চাচ্ছিলেন, আমি যেন সে সুখানুভূতি থেকে বঞ্চিত না হই, যেটা গতকাল পেয়েছিলাম। এ জন্য তিনি আমার প্রতি তার দয়া দেখালেন, আমাকে তার ছেলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। থাইম দিয়ে তৈরি সে স্যান্ডউইচ আমার সব সময়কার জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল; যদিও আমি সে নারীর নাম জানতাম না—এমনকি তিনিও আমার নাম জানতেন না; আমার মুখাবয়ব কেমন, সেটাও দেখেননি তিনি; আমি মানুষের সামনে কতটা হীনতা অনুভব করতাম, সেটাও জানতেন না তিনি।
কিন্তু তার ভেতরের মহান মানবিক সত্তা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার ভেতরের দুর্বল সত্তার জন্য সামান্য হলেও একটা কিছু করার। কিন্তু সে সামান্য কিছুই আমার কাছে অমৃত ছিল। কারণ আব্দুল্লাহর মা তার হাতে তৈরি ছোট্ট স্যান্ডউইচের সাথে হালকা মনুষ্য সুঘ্রাণ মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
একটি সুন্দর হাসি
মানুষের সুঘ্রাণ এক ধরনের বিশেষ সুগন্ধি। যখন আপনি এ সুঘ্রাণ কোনো
কিছুর সাথে মিশিয়ে দেবেন, তখন সেটা অনন্য কিছুতে বদলে যায়। কিছু অর্থ হয়ে যায় মহৎ দান । কিছু খেজুরে গড়ে ওঠে বড় বড় বাগান। মুচকি হাসি হয়ে যায় আশার স্থান। থাইমের স্যান্ডউইচ হয়ে যায় অবিস্মরণীয় স্মৃতি। ‘তোমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তোমার মুচকি হাসা সদাকা’-র ধর্ম, এ ধর্ম
সাধারণ কাজকর্মকেও মহান কিছুতে, অলৌকিকতায়, আশ্চর্য ম্যাটাফিজিক্সে
বদলে দেয়।
এ মুচকি হাসির মূল্য সে দুনিয়াতে কিছুই না, যে দুনিয়ার নিয়ম হচ্ছে :
ألا لا يجهلـن أخـذ علينـا *** فنجهـل فوق جهل الجاهلينـا ‘কেউ যেন আমাদের ভুলে না যায়, নচেৎ আমরাও তার কথা মনে রাখব না।’
যে দুনিয়ার বস্তুগত নিয়ম এমন, সেখানে একটি মুচকি হাসি সদাকা, দান, ভালোবাসার উষ্ণতা।
একবার এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারীর সাথে আমার ঝগড়া বাধে। আমি দেখলাম তার চেহারায় বেশ রাগের ছাপ। সেদিনের সে ঝগড়ার পর আমি আর সেই রেস্টুরেন্টে যাইনি। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। আরো জানতে অথবা পড়তে জীবনটা সুন্দর হোক উদারতার রঙে অরিজিনাল কপি সংগ্রহ করুন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?