তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, তাহলে আমি আত্মহত্যা করব

জামিল, তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো, তাহলে আমি আত্মহত্যা করব।’

খাতা চেক করতে গিয়ে এই একান্ত বার্তাটি চোখে পড়ে যাওয়ায় অত্যন্ত বিব্রতবোধ করলাম। স্পষ্টতই বার্তাটি আমার জন্য লেখা নয়, আমার দৃষ্টির জন্যও নয়, খাতার মধ্যে এল কীভাবে তাও বোধগম্য নয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার পর যখন বার্তার বিষয়বস্তু আমার মাথায় উদিত হলো, তখন বুঝতে পারলাম এমন একটি বিষয় জানার পরে চুপচাপ খাতা চেক করে ছাত্রীকে ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষক হিসেবে না হোক, মানুষ হিসেবে আমাকে কিছু করতেই হবে।

খাতা দেখা শেষে ছাত্রীকে ডেকে পাঠালাম। সময় নির্বাচন করতে হচ্ছিল এমনভাবে যেন সে-সময় আর কেউ রুমে উপস্থিত না থাকে, যেহেতু এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আমার ছাত্রী হলেও বয়সে সে আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়, কিন্তু আমার সকল ছাত্রছাত্রীর প্রতি আমার আচরণ মাতৃসুলভ। তাই তাদের আদর করতে যেমন কুণ্ঠিত হই না, তেমনি বকা দিতেও পিছপা হই না। সে রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ওকে নিয়ে ছুটলাম, ‘তোমরা জীবনটাকে কী মনে করো বলো তো। জীবনটা কি এত সস্তা যে ইচ্ছে হলো আর ছুড়ে ফেলে দিলে? তোমার বাবা-মা কত স্বপ্ন নিয়ে তোমাকে এত বছর ধরে পেলেপুষে মানুষ করেছেন, কত আশা নিয়ে এমন ব্যয়বহুল একটি প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠিয়েছেন। তাদের কথা ভাবলে না? তোমার ভাইবোনের কী হবে তাও না? একটা ছেলেই কি তবে তোমার জীবনের সব হয়ে গেল? পৃথিবীটা কত বড়! অথচ তুমি এমন একজনের জন্য জীবনটাকে তুচ্ছ মনে করছ, যে তোমাকে চায়-ই না! এই চিঠি যদি আমার হাতে না পড়ে তোমার বাবা-মার হাতে পড়ত তাহলে তাদের কী অবস্থা হতো ভেবে দেখেছ?’

আমার কথার তোড়ে ঝড়ে পড়া পাখির মতো কোনোক্রমে ভেসে থাকার চেষ্টায় ছিল সে। এবার বলল, ‘ম্যাডাম, স্যরি, আসলে আমার জানা ছিল না, চিঠিটা খাতার ভেতর ছিল। আসলে ওটা কিছু না।’

এবার মেজাজটা সত্যিই খারাপ হলো। আমি বলি কী, আর আমাকে বলে কী? বললাম, ‘ওটা কিছু না মানে? তুমি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছ, ওটা কিছু না?’

সে আমাকে জানাল, ‘আসলে ম্যাডাম, সে আমার শিক্ষক ছিল। আমি যখন জানতে পারি, বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় ওর স্ত্রী মারা যায়, তাই সে সারাক্ষণ বিষণ্ণ থাকে, আমার মাঝে প্রচণ্ড সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। সহানুভূতি থেকে যে কীভাবে আমি ওকে ভালোবেসে ফেললাম তা নিজেও বুঝিনি। ওকে যখন বললাম আমি ওকে বিয়ে করতে চাই, চাই ওর জীবনের বিষণ্ণতাগুলো সুখের রঙের আড়ালে ঢেকে দিতে, তখন সে শুধু বলল, ‘আমার সাহস হয় না। একবার স্বপ্নভঙ্গের পর আবার ঘর সাজাতে ভয় হয়।।’ আমি তখন দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম ম্যাডাম। আমি ওকে চাপ দেয়ার জন্য এই চিঠিটা লিখেছিলাম।’

আমি বললাম, ‘তুমি যদি একান্তই তাকে বিয়ে করতে চাও তাহলে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলো, তাদের মাধ্যমে যা করার করো। আর এই সমস্ত বাজে চিন্তা থেকে দূরে থাকো। ঠিক আছে?’

সে বলল, ‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ম্যাডাম, আমি আর ওই ধরনের চিন্তা করব না।’

ধরে নিই ওর নাম স্বাতী। আমি সেই ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিই ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের উদ্বোধনী শিক্ষকদের একজন হিসেবে। তখন ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের অনার্সের একটাই ব্যাচ। এই উদ্বোধনী ব্যাচটি ছিল আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং মেধাবী ব্যাচগুলোর একটি। এদের বাবা-মা এদের যেকোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করাতে পারতেন কিন্তু শুধুমাত্র মেয়েদের আলাদা ক্যাম্পাস হবার কারণে এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পাঠান।

স্বাতী যেমন লেখাপড়ায় ভালো ছিল, তেমনি বিতর্ক, বক্তৃতা, আবৃত্তি, স্মার্টনেস, কনফিডেন্স কোনো দিকেই পারদর্শিতা তার অভাব ছিল না। দেখতেও ছিল চমৎকার। এই ঘটনার তিন মাস পর একদিন ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাসের গেটে ওর সাথে দেখা। সে বলল, ‘ম্যাডাম, প্লিজ একটু এদিকে আসুন।’ ওর সাথে গিয়ে দেখলাম একপাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝারি গোছের, শ্যামলা। সে বলল, ‘ম্যাডাম ইনিই জামিল, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম। কিছুদিন হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।’ তাদের অভিনন্দন জানালাম, জামিলের মুখের হাসিটাই জানান দিচ্ছিল স্বাতীর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ভাবছিলাম, সবাই যদি এমন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়ে করত কত ভালোই না হতো!

বই: ওপারে
লেখিকা: রেহনুমা বিনতে আনিস