মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায় – একটি জীবন একটি ইতিহাস

একজন সাহিত্যিককে সম্পূর্ণরুপে সাহিত্যিক না বলা গেলে তাকে আর কি বলা যেতে পারে? তিনি সাহিত্য লিখেন, সাহিত্য জানেন, সাহিত্য নিয়ে গভীর চিন্তা করেন। তবু তৎকালীন সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মাঝে তার কোনো বিস্তর জানাশোনা নেই। বিখ্যাত— অথচ কোনো বন্ধু নেই। ৪৮ বছরের জীবনে ৫৭ টি গ্রন্থের একটিতেও কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উৎসর্গ করে নয়। গোড়া কমিউনিস্ট কিন্তু চূড়ান্ত ব্যক্তিত্ববাদী – তার রচনার মতোই একক ও একচ্ছত্র ।

মানুষটি প্রবোধকুমার বন্ধ্যোপাধ্যায় ওরফে মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়। দেখতে শ্যাম বর্ণের প্রবাল দেহ আর কঠোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অথচ স্বভাবে স্পষ্টভাষী, নির্জন, চিন্তাশীল, বিশ্লেষণ প্রবণ এ লেখকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে বরাবরই ছিল কেবলই মানুষ। তাই পরবর্তীতে তাঁর রচনা বিশ্লেষণ করলে আমরা সেখানে বস্তুজগৎ ও অন্তর্জগৎ – প্রকৃতিচিত্রণ কমই দেখতে পাই।

“একটুখানি বুদ্ধি থাকলে যে কোনো লোক পাঠযোগ্য গল্প লিখতে পারে।” — সাহিত্য বিতর্কে নিজের এই বক্তব্যকে সত্য প্রমাণ করতে তিন দিনের মধ্যে লিখে ফেললেন তার প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’। প্রকাশিত হয় বিচিত্রা পত্রিকায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে পড়া সে ছাত্র সেই যে আকস্মিক সাহিত্যে যুক্ত হলেন, মৃত্যু অবধি তা থেকে অবসর নেয়ার আর সুযোগ হয়ে উঠেনি। লেখাপড়ার ইস্তফাও এ সময়ে টেনে দেন।

মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায় স্বাধীনচেতা ও দূরদরশী একজন লেখক ছিলেন। তাঁর সময়ে রবীন্দ্র পরবর্তী কল্লোলীয় যুগে বাংলা সাহিত্যে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল তিনি তা সমর্থন করলেও, এ গোষ্ঠী বা যুগের লেখক বলে নিজেকে মনে করতেন না। তিনি যেমন এ যুগকে বাংলা সাহিত্যের এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ বলে আখ্যায়িত করেন ঠিক তেমনি আবার এর ব্যর্থতা স্বীকার করে বলেন, কল্লোল প্রকৃত বস্তুপন্থী সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন নি।

তবে মানিকের নিজস্ব সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরুতে তিনি নিজেও কল্লোলীয় ধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর লেখা ‘অতসী মামী’ ও ‘দিবারাত্রির কাব্য’ যার সফল উদাহরণ। তবে সময়ের পরিপক্কতায় পরবর্তীতে রবীন্দ্র-শরৎ প্রভাব থেকে তাকে ক্রমেই মৌলিক লেখকে পরিণত করে। নিজেকে বারবার নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টাই তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে।

বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্র মানিক কৈশরে ফ্রয়েডবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেও সাহিত্য জীবনে এসে তা পরিত্যাজ্য করেন। তাঁর সাহিত্যে মানুষের আবেগের থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন বাস্তবতা তথা সামাজিক ব্যস্ততাকে। তিনি মনে করতেন সাহিত্যে মানুষের অতি মিশ্রিত আবেগ বা রোমান্টিসিজমের থেকে বেশি যখন গূঢ় বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ হবে তখনই তা প্রকৃত সাহিত্য বলে ফুটে উঠবে।

উনিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বে ঘটে যাওয়া বাস্তববাদী শিল্পের অভ্যুত্থানে সামিল হতে সর্বোপর চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর স্ব-স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেছেন, “সচেতনভাবে বস্তুবাদের আদর্শ গ্রহণ করে সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সাহিত্য করিনি বটে – কিন্তু ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল।”

অপরদিকে ফ্রয়েড ও মার্ক্সের ব্যাপারে মানিক যেমন সুস্পষ্ট ছিলেন, অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে তাঁর তেমন স্পষ্ট উল্ল্যেখ না থাকলেও, যখন ‘পুতুলনাচের ইতিকথায়’ শশী বলে উঠে, “ কাজ আর দ্বায়িত্ব ছিল জীবনে, কাজ আর দ্বায়িত্বের জীবনটা আবার ভরপুর হয়ে উঠিল” তখন এর মধ্যে আমরা অস্তিত্ববাদী চরিত্রের প্রভাব প্রকটভাবে ফুটে উঠতে দেখি।

নিজের সাহিত্য জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অস্তিত্ববাদী ও মার্ক্সবাদীর এক সম্মিলন সাধন করেছিলেন মানিক। ‘আরোগ্য’ উপন্যাসে এসে যখন কেশব আবিষ্কার করে “ ‘ব্যক্তিগত’ অসুখের কারণ ‘সামাজিক’ “– তখন আমরা এর মাঝে মানিকের এমন আদর্শের অস্তিত্ব দেখতে পাই। তবে মানিকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন যে, তাঁকে নির্দিষ্ট কোনো প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করা যায় না। যখন তিনি বিশুদ্ধ মার্ক্সবাদী তখন তাঁর মাঝে থাকা পূর্বের ফ্রয়েডকেও বর্জন করতে পারেন নি। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে তিনি ছিলেন সদা সচল, পরিবর্তমান, ক্রম অগ্রসমান।

ব্যক্তি জীবনে সাহিত্যের মতো মানিক তাঁর নিজের চিন্তাচেতনায় স্বাধীন ছিলেন। ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্টে যোগ দান করার পর যখন ১৯৪৬ সালে দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকায় নেমেছিলেন- তখন এর জন্যে তাঁকে শুনতে হয়েছিল ‘মুসলমানদের দালাল’। তবু নিজ জীবনের শেষ দিন অবধি তিনি কমিউনিস্ট দলের সদস্য হিসেবেই ছিলেন।

বাবার চাকরি সূত্রে দেশ ঘুরে বেড়ানো চঞ্চল, দুরন্ত মানিক তাঁর এই স্বাধীনতার অধিকার ছোটতেই অর্জন করেছিলেন। হঠাৎ দিন চার-পাঁচের জন্য জন্য হারিয়ে যেতেন টাঙ্গাইলের মাঝিমাল্লার দেশে, কখনো বা টালিগঞ্জের বস্তিতে কাটিয়ে দিতেন সারাদিন। বোধ হয় এর জন্যেই তাঁর উপন্যাস-গল্পে বস্তুবাদ মানুষের অস্তিত্বের সমুখ ধারণা আমাদের চিন্তায় বিস্মিত করে তোলে। অবশ্য এ নিয়ে মানিক নিজেই গর্ব করে বলেন, “…… আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুটি জেনেছি।”

সাহিত্যের ভূত মাথায় চাপবার পর যখন বড়ো ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে ১৯৩০ এ ঘর ছেড়েছিলেন, তখন থেকে দারিদ্রতা আর তাঁর পিছু ছাড়ে নি। মানিক চাকরী বিরোধী ছিলেন। তবে তিনি চাকরী করেছেন আবার খারিজও হতেন। এর মাঝে ১৯৩৫ এ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ লিখবার সময় তাঁর আজীবনের সঙ্গী হয়ে আসে মৃগী রোগ। এ বছরই গ্রন্থকার হিসেবে আবির্ভূত হন।

এভাবেই চাকরী, বিবাহ, একটি ছোট প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় তাঁর জীবন। তবু নিজের জীবনকে কখনো ছোট করে দেখেন নি তিনি। বড়ো ভাইকে দেয়া এক চিঠিতে তিনি গর্ব করে লিখেছিলেন,” …… তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক স্বীকার করিয়াছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরবর্তী যুগে আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক।”


তবে মানিকের ব্যাপারে পরে মোহিতলাল বলেছিলেন, শুরুর দিকে যে শক্তিশালী মানিককে পাঠক আবিষ্কার করেছিল, বয়সের সাথে সাথে তা তার শক্তি হারিয়েছে। যা তাঁকে একজন রূপকার কবির আসন থেকে রূপ-বিদ্রোহী কর্ম্মকারের পদবীতে নামিয়ে এনেছে।

দস্তয়েভস্কি যেমন ছিলেন জুয়ায় আসক্ত, তেমনি মানিক ছিলেন মদ্যাসক্ত। দুজনেই ছিলেন মৃগী রোগী। দস্তয়েভস্কি যেমন জুয়ায় সর্বস্ব না-হারানোর পর্যন্ত লেখায় বসতেন না, মানিকের কাছে আসরও ছিল তেমনি। শেষ জীবনে যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত।

জীবনের দারিদ্রটা যখন চরমে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তাঁকে মাসিক ১০০ টাকা বৃত্তি হিসেবে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও তাঁর ঋণ পরিশোধের জন্য রাজ্য সরকার এককালীন ১৯০০ টাকা দিয়েছিলেন। ৪৮ বছর বয়সের শেষে এমনই কোন এক ভোরে নীলরতন সরকার হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় মৃত্যু হয় বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম কথা-সাহিত্যিক মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের। সময়টি ছিল, ১৯৫৬ সাল ৩ ডিসেম্বর ; বাংলা, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৩৬৩।

উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যকে রোমান্টিসিজম বা অতি কল্পনীয় ধারা থেকে পরিত্রাণ দিতে ১৯২৩ সালে দীনেশরঞ্জন দাশের প্রতিষ্ঠা করা ‘কল্লোল’ পত্রিকার হাত ধরেই বলা চলে বাংলায় কল্লোলীয় যুগের আবর্তন। কল্লোলীয় যুগ মূলত রবীন্দ্রোত্তর ও বস্তুবাদকে আদর্শ ধরে বাংলা সাহিত্যে যে পালাবদল ঘটে সে সময়কালকেই বোঝানো হয়।

এ যুগের সূচনায় ভূমিকা রেখেছিলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যিকেরা। কল্লোলীয় চেতনার মূলে আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্রোত্তর বস্তুবাদী সাহিত্য সৃষ্টি, কবিতা ও কথাসাহিত্যে দ্রোহী চেতনা, বিদেশি সাহিত্য থেকে পরিগ্রহণ ইত্যাদি ছিল এ যুগের প্রধান বিষয়বস্ত।

তথ্যসূত্র : মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায় অন্তর্বাস্তবতা বহির্বাস্তবতা
লেখক : আবদুল মান্নান সৈয়দ
প্রথমা প্রকাশনী

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *